মহালয়ার দিনে ফিরে ফিরে আসে অনুচ্চারিত প্রশ্নমালা

শরতের তুষার শুভ্র মেঘের ভেলায় চেপে ফি বছর মহালয়া ফিরে ফিরে আসে। শিউলির গন্ধে বিভোর হয় কাকভোর। ঘাসের ডগা দুলে ওঠে শিশিরের আদুরী পরশে। মেঠো ফুল খিলখিল করে হেসে ওঠে। কাশফুলের অন্তরে জমাট বাঁধে প্রাণের হিল্লোল। ঘর-গেরস্থালিময় ভেসে বেড়ায় পুজোর গন্ধ। এমনই উতলা ক্ষণে ফি বছর বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের আলোআঁধারি মায়াবী ভোরে ‘ওঁ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমঃ নমঃ’-য় আপ্লুত হয় তন্দ্রাচ্ছন্ন বঙ্গ আবেগ। শারদীয়ার আগমনীর উষ্ণ প্রস্রবণে প্রশান্তির অবগাহন করে বঙ্গদেশের আবালবৃদ্ধবনিতা। কিছুকালের জন্য হলেও বাঁধনহারা খুশিতে ভেসে যায় জীবনের সকল গ্লানি।

জীবন পথের অনেকটা পার হয়ে আসার পরে সেই কবেকার আতস চোখ আজও খুঁজে ফেরে শৈশবের স্মৃতি, কৈশোরের আকুতি, যৌবনের দীপ্তি। মহালয়ার মন্ত্রমুগ্ধ কাকভোরের প্রাক্কাল থেকেই রাতে বিছানায় শুয়ে অশীতিপর ঠাকুমার মুখে শুনতাম বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের ‘দ্যাশের বাড়ির’ অনাড়ম্বর দুগগা পূজোর বিরামহীন উপাখ্যান। স্বর্গলোকের গল্প, দুগগা সৃষ্টির গল্প, মহিষাসুর বধের গল্প। তখন বোধগম্যতা ছিল সীমাবদ্ধতায় বিদ্ধ। সংস্কৃত মন্ত্রের নির্যাস নিয়ে তখন এতটুকুও মাথা ব্যথা হওয়ার কোনো ফুরসতই ছিল না। দুর্গা পূজোর গুঢ় দর্শন-তত্ত্ব তখন বোধগম্যতার নাগালের থেকে সহস্র যোজন দূরে। কিন্তু সেই কাঁচা বয়েসের টগবগে হৃদয় পেতে জীবন থেকে যা কিছু নিতে পেরেছি, সেই সঞ্চয়ের স্মৃতির জাবর কেটেই তো এই বয়েসে এক্কাদোক্কা করে এগিয়ে চলেছি জীবনপথ পরিক্রমার এক পাতা থেকে অন্য এক পাতায়।

জীবনের সর্পিল পথে জটিলতা স্তূপীকৃত হয়। মনের বয়সে স্থূলতা জমে। মার্ক্স সাহেবের ‘দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ’ বোধগম্য হোক বা না হোক, দ্বন্দের ভিড়ে মনের ছন্দপতন ঘটে। আজকের কাঁচাপাকা চুলের ফাঁকে যে সকল অগনিত প্রশ্নমালা এসে ভিড় জমায়, সেদিনের শিশুমনে একবারের জন্যেও সেই সব মৌলিক প্রশ্ন নিরসনের এতটুকুও স্পর্ধা জাগেনি। দুর্গা মা কেন মহিষাসুর নামক দুষ্টকে অস্ত্র দিয়ে বধ করে শায়েস্তা করলেন? সকল দেবতাকুলের বলে অসীম বলীয়সী দুর্গা মা মহিষাসুরের মন থেকে পাশবিক প্রবৃত্তিগুলো কেনই বা সমূলে উৎপাটিত করতে পারলেন না? নাকি তার কোনো চেষ্টাই তিনি করেননি? অন্তরাত্মা পরিবর্তনের সেই চেষ্টা না করার পেছনে প্রকৃত কারণ কী ছিল? অসীম শক্তি আর বিপুল অস্ত্রসম্ভারের প্রত্যয়ই কি দুর্গা মাকে অপেক্ষাকৃত সহজ পন্থা অবলম্বন করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল? যার কাছে ক্ষমতা থাকে, শক্তি থাকে, অস্ত্র থাকে, তিনি কি ক্ষমতা, শক্তি আর অস্ত্রের প্রত্যয়েই সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে নেন? পৃথিবী নামক গ্রহের তথাকথিত ‘সভ্য’ মানবসমাজ আর স্বর্গের দেবতাদের মধ্যে এক্ষেত্রে কি অনেক মিল রয়েছে? যারা শাসকের পরিবর্তন চায়, তাঁরা হয়তো এই সিস্টেমে শেষ পর্যন্ত টিকে যায়। কিন্তু যারা এই সিস্টেমের বদল চায়, তাদেরও কি এই মহাশক্তিধর সিস্টেম এভাবেই শক্তির প্রত্যয়ে নিশ্চিহ্ন করে ফেলে? ক্ষমতার দম্ভের ঔদ্ধত্বে, শক্তির আস্ফালনের স্পর্ধায়, অস্ত্রসম্ভারের ঝলকানির মত্ততায়! যারা রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলে, তাদের দমন করার রীতি কি স্বর্গ, মর্ত, পাতালব্যাপী একইভাবে বিস্তৃত? ক্ষমতাবানের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদের শিরদাঁড়া কি যুগ যুগ ধরে অবদমিত থেকে যাবে উদ্যত মারণাস্ত্রের উদ্ধত স্পর্ধার কাছে? নিস্তব্ধতা ফুঁড়ে উত্তর কিন্তু ফিরে আসে না!

মা দুর্গা, যিনি কিনা জগৎজননী মহামায়া। যার ইচ্ছা-অনিচ্ছাতেই ধরাধাম জুড়ে চলে অবিরাম ভাঙাগড়ার জাগতিক খেলা। সেই তিনিই বা কেন অস্ত্র সম্ভারে সুসজ্জিত হয়ে মর্ত্যলোকে আসবেন? তবে কি জগৎজননী মহামায়াও দুষ্টের দমনের ক্ষেত্রে কোথাও অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছিলেন? না হলে তিনি দুষ্টের দমনে মারণাস্ত্র প্রয়োগ বিনা বিকল্প কোন পথের দিশা দেখাতে পারলেন না কেন? এক অসুরের শরীরকে বিনাশ করেই কি স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের সমগ্র পাশবিক প্রবৃত্তিকে নিবৃত্ত করা যায়? এই জগৎ সংসারে অত্যাচার, অবিচার, লাঞ্ছনা, বঞ্চনা যখন পর্বতের শিখর ছুঁয়ে ফেলে, তখন জগৎজননী মহামায়া ‘রণং দেহি’ মূর্তি ধারণ করে এই ধরাধামে আবির্ভূতা হয়ে দুষ্টের দমনে অগ্রণী হন না কেন? যখন হাথরসের তরতাজা মেয়েটির মাংস পোড়া গন্ধ গোটা ভূভারতকে আন্দোলিত করে। অথবা উন্নাওয়ের নির্যাতিতা যখন ন্যায়ের অন্বেষণে প্রাণপণে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে অসম শক্তিধরের বিরুদ্ধে। কিংবা নির্ভয়ার লাঞ্ছিত, ছিন্নভিন্ন শরীর যখন রাজধানীর ঝাঁ চকচকে রাজপথে পড়ে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে। তখন সর্ব পাপহর দেবীর ‘শক্তিরূপেণ সংস্থিতা’ না হওয়ার পেছনে পক্ষপাতিত্বের গন্ধ লেগে থাকে বৈকি! এ হেন মানুষরূপী অসুরদের শায়েস্তা করতে দুর্গা মায়ের খঞ্জর তখন কেনই বা অবসন্ন হয়েই থেকে যায়? তবে কি কলিযুগের লক্ষ্মী-সরস্বতীদের আর্তচিৎকার মা দুর্গার কানে পৌঁছনোর সকল পথ রুদ্ধই থেকে গেল!

যে কথা, যে ব্যথা, যে আশা, অন্যের সাথে ভাগ করে নিতে অসুবিধা হয়, সেগুলোই তো মানুষ প্রার্থনার মাধ্যমে ঈশ্বরকে জানিয়ে নিজ আত্মাকে তৃপ্ত করে। মানুষের সেই বিন্দু বিন্দু বিশ্বাস দিয়ে তিলতিল করে গড়ে তোলা প্রাণের ঈশ্বর, অথবা পূজিত সেই ঈশ্বরের প্রার্থনা স্থল। কোন কিছুই কি ছাড় পেয়েছে উন্মত্ত হিংস্রতার কাছ থেকে! তা সে পরদেশ আফগানিস্তানের বামিয়ানেই হোক, কিংবা নিজদেশ অযোধ্যায়। তবু কেন অস্ত্রসম্ভারে সুসজ্জিতা কোন দেবী দুর্গা ধরার ধূলিতে নেমে এসে তা প্রতিহত করতে উদ্যত হন না? ধর্মের দোহাই দিয়ে পৈশাচিক উল্লাসে মানুষ যখন মানুষকেই নির্বিচারে হত্যা করে। অথবা ধর্মকে ব্যবহার করে যখন রাজনীতির কারবারিরা লাভের পাহাড় স্তূপীকৃত করে ফেলে। কিংবা অসহিষ্ণুতার কালো মেঘে যখন ছেয়ে যায় সমগ্র দেশ তথা পৃথিবীর সমাজ প্রাঙ্গণ। আমাদের বহু বিভাজিত সমাজকে যখন আরও খণ্ডাংশে বিভক্ত করা হয় শুধুমাত্র ভোট বৈতরণী পার হওয়ার উদগ্র বাসনায়। তথাপি মারণাস্ত্রে অলংকৃতা দেবী কেনই বা কেবলই মৌনই থেকে যান?

সেদিনের শিশুমন এইসব মৌলিক প্রশ্নের উত্তর জানতে চায়নি কারও কাছে... সাজসজ্জা, অস্ত্রশস্ত্র, ভরা সংসার নিয়ে মণ্ডপে অধিষ্ঠিতা দুগগামার কাছে, রাতে বিছানায় শুয়ে অশীতিপর ঠাকুমার কাছে, বাড়ির গুরুজনদের কাছে, পাড়াপড়শিদের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে, সিস্টেম-এর কাছে। সেদিন সম্বল ছিল শুধু প্রানভরা বিশ্বাস। সেই ‘সোনালী সোনালী দিনগুলিতে’ মনের আদিগন্ত জুড়ে ফুটে থাকা কাশফুলের কাঁপনে প্রাণ জিরিয়ে, আশ্বিনের ঝলমলে শারদ আকাশের মেঘবালিকার স্বপ্নে চোখ বুলিয়ে, মন পাড়ি দিতো অমৃতলোকের অনন্ত মুক্তির ইশারায়। পারিবারিক দৈন্যদশাও যাকে ম্লান করতে পারেনি কখনও। আজও অবসন্ন দেহ-মনের আনাচে কানাচে লেগে আছে জীবনের প্রথম লগ্নের সেই কাকভোরের আকুতি। জীবন নদীতে ভাসতে ভাসতে কত কিছুই তো বয়ে গেল জীবনভর। কত বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ফুল, বেলপাতা, মন্ত্রোচ্চারণ! ঘাটে ঘাটে ভেসে গেল কত শত স্মৃতিবিজড়িত আনন্দপ্রতিমা... সব সাজসজ্জা নিয়ে, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে, মন কেমন করা আজন্মের ভালোবাসা নিয়ে। বোধহয় এভাবেই পেরিয়ে যায় সব সখ্য! তবু শরতের তিরতিরে বাতাসে কাশফুলের আশ্বাসে আঁচল ভিজিয়ে আবার এক বীরে কৃষ্ণের মন্ত্রোচ্চারণের আচ্ছন্নতায় আপ্লুত শিউলি বিছানো কাকভোর ঠিক একদিন এসে মন্ত্রমুগ্ধের মতো হাজির হয়। যে ভোরের আলোআঁধারি মায়াজাল আমার মতো অগনিত বঙ্গ প্রৌঢ়কে একদিন শিখিয়েছিল আগমনীর বোলে নাচতে, শারদ প্রান্তরে থরে থরে ফুটে থাকা কাশফুলের অন্তরের দোলায় দুলতে, মন খারাপের বিসর্জনের বিকেলে উদাত্ত কণ্ঠে রবি বাউলের গান গাইতে। ততদিনে হয়তো অসংখ্য শিউলি অকাতরে ঝরে গেছে। ততদিনে হয়তো পদ্ম-বোনা পুকুর পাড়ে শ্যাওলা এসে ভিড় করেছে। ততদিনে হয়তো কাশফুলের আন্দোলনে রক্ত এসে জমাট বেঁধেছে। তবু  কবেকার সেই আতস চোখ আজও শুঁকে বেড়ায় সেই শিউলি বিছানো শরতের কাকভোর, বীরেন্দ্র কৃষ্ণের সেই মন্ত্রমুগ্ধ শিহরণ, কাশফুলের সেই উদাত্ত হিল্লোল।

(লেখক বঙ্গবাসী সান্ধ্য কলেজের বাণিজ্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এবং সিমলার ইন্ডিয়ান ইন্সিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডি-র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট। মতামত ব্যক্তিগত।)

Powered by Froala Editor