ল্যুইস ওয়েবার: সিনেভাষার এক পথিকৃৎ

‘স্প্লিট স্ক্রিন’ টেকনিক। এর মানে হল এমন একটা ফ্রেম যার বিভিন্ন অংশে একাধিক চরিত্রের একই সময়ে বিভিন্ন স্থানিক মুহূর্ত তুলে ধরা। হলিউডের বেশ কিছু গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড ছায়াছবি যেমন ইনগ্রিড বার্গম্যান, ক্যারি গ্রান্ট অভিনীত ‘ইনডিস্ক্রিট’, উডি অ্যালেনের পরিচালনায় ‘অ্যানি হল’, নিও নোয়ার গোত্রের ছায়াছবির এক মাস্টার নির্মাতা ব্রায়ান ডি পালমার একাধিক ছবি যেমন ‘সিস্টার্স’, ‘ড্রেসড টু কিল’ এইসব চলচ্চিত্রের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যে এই টেকনিকের সার্থক প্রয়োগ হয়েছে। কোনো দৃশ্যের টেনশন বা অভিঘাত অনেকটা বেড়ে যেতে পারে বিপ্রতীপ কিছু চিন্তাভাবনা, বস্তু বা চরিত্রের এইভাবে সম্মিলন ঘটালে। ভাবতে ভালো লাগে যে প্রবলভাবে ম্যাস্কুইলিন এক ইন্ডাস্ট্রিতে একজন মহিলা পরিচালক এই টেকনিক সর্বপ্রথম প্রয়োগ করেছিলেন একশো বছরেরও বেশী আগে। ১৯১৩ সালে নির্মিত নির্বাক, সাদাকালো স্বল্প দৈর্ঘ্যের থ্রিলার ছায়াছবি ‘সাসপেন্স’, ফিলিপস স্মলির সঙ্গে যুগ্মভাবে যে চলচ্চিত্রের পরিচালনা করেন ল্যুইস ওয়েবার। ছবিতে এক মুখ্য চরিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি ছবির চিত্রনাট্যও লেখার কৃতিত্বও ছিল ওঁরই। এই ছবিতেই প্রথমবার এই স্প্লিট স্ক্রিনের প্রয়োগ করা হয়, যে প্রয়োগ ভবিষ্যতে এই ধরণের সিনেমার ক্ষেত্রে এক সার্থক টেমপ্লেট হিসেবে রয়ে গেছে। 

১৯১৩ সালে নির্মিত ‘সাসপেন্স’ ছায়াছবির এক আইকনিক দৃশ্য যেখানে ‘স্প্লিট স্ক্রিন’ টেকনিক প্রথমবার প্রয়োগ করা হয়

 

১৮৭৯ সালের ১৩ই জুন অর্থাৎ ঠিক আজকের দিনেই পেনসিলভেনিয়ার অ্যালিঘেনি সিটিতে জন্ম হয় ল্যুইসের। ওঁর পরিবারের উৎস লুকিয়ে আছে এক জার্মান রক্ষণশীল আবহে। ছেলেবেলাতেই পিয়ানো বাজানোর দক্ষতা দেখে ওঁকে এক চাইল্ড প্রডিজি ভাবা হয়েছিল। পরে বাড়ি থেকে চলে গিয়ে একা একা কিছুদিন দারিদ্র্যের সঙ্গেও কাটাতে হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু পারিবারিকভাবে ক্যাথলিক আবহে বড়ো হয়ে ওঠার জন্য চার্চের সঙ্গে এক সহজ সম্পর্ক ছিল ল্যুইসের। চার্চের হয়ে নানা সমাজ সংস্কারের কাজও করেছিলেন তিনি। এর মধ্যে আবার কনসার্ট পিয়ানিস্ট হিসেবে সারা আমেরিকা ট্যুর করেছিলেন। ১৯০৪ সালে দক্ষিণ ক্যারোলিনার চার্লস্টনে এমনই এক কনসার্টে বাজানোর সময় হঠাৎ পিয়ানোর একটা কী ভেঙে যাওয়ার ঘটনা মানসিকভাবে ওঁকে বিপর্যস্ত করে দেয়। সেবারই কনসার্ট থেকে বিদায়ের পালা। জীবনের এই অস্থির মুহূর্তে অভিনয় ওঁর আগামী দিনের এক নোঙর হিসেবে এসেছিল। অভিনয় বলতে থিয়েটারে অভিনয়। এই সময়ই ওঁর সৃষ্টি জীবনের সঙ্গী ফিলিপসের সঙ্গে আলাপ, পরিচয় এবং পরিণয়ের ঘটনা। এই জীবনে বেশ কয়েক বছর কমেডি এবং মেলোড্রামা নাটকের এক মুখ্য অভিনেত্রী এবং গায়িকা হিসেবে কাজ করেছিলেন ল্যুইস। 

১৯০৮ সালে এসে গেল আমেরিকান গোমোঁ ক্রোনোফোন কোম্পানিতে অভিনেত্রী হিসেবে প্রথমবার চলচ্চিত্রে কাজের সুযোগ। সে সুযোগ সার্থকভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ভেতরে লুকিয়ে থাকার এক স্রষ্টার মনন বুঝতে চাইছিল চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত সমস্ত দিকগুলোকে। এর ফলে দেখা যায় কিছুদিনের মধ্যে অভিনয়ের পাশাপাশি দক্ষ স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে তিনি একের পর এক ছায়াছবির চিত্রনাট্য লিখছেন। ওই সময় সেট ডিজাইন, কস্টিউম প্রভৃতি ডিপার্টমেন্টেও কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন ল্যুইস ওয়েবার। ১৯২৭ সালে পৃথিবীর প্রথম টকি ‘দ্য জ্যাজ সিংগার’ মুক্তি পাওয়ার প্রায় দেড়দশক আগে পরীক্ষামূলকভাবে আমেরিকার প্রথম সাউন্ড ফিল্ম নির্মান করেছিলেন ল্যুইস। এমনকি ১৯১৪ সালে স্মলির সঙ্গে যৌথভাবে নির্মিত প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছায়াছবি ‘দ্য মার্চেন্ট অফ ভেনিস’ পরিচালনার কৃতিত্বও ওঁরই, কিছু স্টিল ছাড়া যে ছবির কোন হদিশ আজ আর নেই। মনে রাখা দরকার যে পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবির ব্যাকরণের এক সার্থক পুরোধা হিসেবে যে ছবি স্বীকৃত ১৯১৫ সালে নির্মিত ডি ডব্লু গ্রিফিথের সেই বিখ্যাত ছায়াছবি ‘দ্য বার্থ অফ আ নেশন’ মুক্তি পাওয়ার একবছর আগে এই ছবি তৈরি হয়। 

আরও পড়ুন
প্রথম চলচ্চিত্রের আগেই বানিয়ে ফেলেছিলেন পঞ্চাশেরও বেশি ছবি!

১৯১৫ সালে ওঁর পরিচালনায় নির্মিত হয় ‘হিপোক্রিটস’ নামে বিখ্যাত এবং অত্যন্ত বিতর্কিত এক ছায়াছবি, যার চিত্রনাট্যও ছিল ওঁরই লেখা। পর্নোগ্রাফিক ছবির বাইরে ফুল ফ্রন্টাল ন্যুডিটি প্রথম এই ছবিতে উঠে এসেছিল, গল্পের চলনে ক্যাথলিক মর‍্যাল সাবটেক্সটও ওই ভিস্যুয়াল অবস্থানের সপক্ষে জনমত গড়তে পারেনি তখন। এই ছবির মুক্তি তথা প্রদর্শন নিয়ে খোদ সংস্কৃতির এক অন্যতম পীঠস্থান নিউইয়র্ক শহরেও রায়ট লাগে। ওহায়োতে এই ছবি ব্যানড হয় এমনকি বোস্টন শহরের মেয়র দাবি জানান যে মুক্তির আগে যেন নেগেটিভে ফ্রেম ধরে ধরে নগ্ন অভিনেত্রীর সারা গায়ে পোশাক এঁকে নেওয়া হয়। 

আরও পড়ুন
সত্যজিৎ-স্মরণে শর্টফিল্ম ফেস্টিভাল, আয়োজনে কলকাতার এক দল তরুণ চলচ্চিত্রকার

১৯১৫ সালে মুক্তি পাওয়া হিপোক্রিটস ছবির এক দৃশ্য

 

আরও পড়ুন
'৯৫-এর আগেই কলকাতায় চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন, সাক্ষী সত্যজিৎ-ঋত্বিক

ওয়েবারকে ঠিক আধুনিক ভাষ্যে নারীবাদী বলা যায় না। ধর্মীয় আবহের নানা মেসেজ তিনি তুলে ধরেছিলেন তাঁর ছবিতে। যদিও সেসব ছবির মধ্যে ক্যাথলিক মর‍্যালিটির প্রোপাগান্ডার ছোঁয়া আছে। এর মধ্যেও কিন্তু ১৯১৬ সালে নির্মিত ‘হোয়্যার আর মাই চিলড্রেন?’ ছবিতে অ্যাবরশনের মত প্রায় ক্যাথলিক ট্যাবু এক বিষয় উঠে এসেছিল। এডগার রাইস বারোজের সৃষ্ট জনপ্রিয় চরিত্র টার্জান এর প্রথম সিনে নির্মানের চিত্রনাট্য লেখার কৃতিত্বও ওঁরই। 

ল্যুইস ওয়েবারের চিত্রনাট্য অবলম্বনে ১৯১৮ সালের ছায়াছবি ‘টার্জান অফ দ্য এপস’ এর এক বিখ্যাত দৃশ্যে টার্জানের ভূমিকায় এলমো লিংকন। জনপ্রিয় এই চরিত্রকে এই প্রথমবারই দেখা যায় রুপোলি পর্দায়।

 

যে কারণে তিনি ব্যতিক্রমী এবং প্রণিধানযোগ্য তা হল অনেক পরবর্তী সময়ে ফরাসি নব তরঙ্গের আদলে যে অট্যুর ধারার প্রথাগত সূচনা হয় তার অনেক দশক আগেই একজন সার্থক অট্যুর হিসেবে চলচ্চিত্র মাধ্যমের সম্পূর্ণ ক্রাফটকে আত্মস্থ করেছিলেন ল্যুইস। যে ধারণা অনুযায়ী একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হলেন আসলে একজন অথর বা লেখক। চিত্রভাষার নানা অনুষঙ্গ যেমন ক্যামেরা, সেটডিজাইন, চিত্রনাট্যের বয়ান এই সবকিছুই আসলে অট্যুর বা অথরের মনের ছবিকেই প্রকাশ করে। আন্দ্রে বাঁজার অনেক আগে গত শতাব্দীর সেই দ্বিতীয় দশকেই এই দার্শনিক বীক্ষার সার্থক প্রতিফলন হয়েছিল ল্যুইস ওয়েবারের সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে। ১৯১৭ নাগাদ ওঁর নিজস্ব একটা ফিল্ম স্টুডিও ছিল। একজন মহিলা পরিচালকের ক্ষেত্রে সারা বিশ্বে এই ঘটনা প্রথম। ওই সময় গ্রিফিথ, সিসিল বি ডিমিল এর মত নির্মাতা নির্দেশকের পাশাপাশি সবচেয়ে বড়ো ব্যানারের বাণিজ্যসফল আবার নিরীক্ষাধর্মী কাজের সঙ্গে ল্যুইস ওয়েবারের নাম জুড়ে আছে। যদিও ওই শতাব্দীরই দুইয়ের দশক থেকে জ্যাজ সংগীতের আবহ, মুক্ত - স্বাধীন জীবনের হাতছানি, মহিলাদের অবস্থান সব মিলিয়ে সুর বদলে গেছিল আমেরিকান সমাজের। ওঁর ছবিতে ক্যাথলিক মর‍্যালিটির সিনে প্রতিফলন সেই বদলে যাওয়া সময়ের হৃদস্পন্দনকে তুলে ধরছিল না। যদিও এই দশকের শুরুতেই ১৯২১ সাল নাগাদ তিনি নির্মান করেছিলেন ‘দ্য ব্লট’ যাকে অনেক সিনে গবেষক ওঁর মাস্টারপিস হিসেবে ধরেন। এই ছবিতে গ্রেট ডিপ্রেশনের প্রায় এক দশক আগে একজন ক্রান্তদর্শীর মতই দারিদ্র্যের এক গভীর রেখাচিত্র এঁকেছিলেন ল্যুইস। এই দশকের শেষেই ডি মিলের প্রযোজনায় ল্যুইসের পরিচালিত শেষ নির্বাক ছবি ‘দ্য অ্যাঞ্জেল অফ ব্রডওয়ে’ মুক্তি পায়। এই ছবিকে নিয়ে নির্মাতাদের অনেক আশা থাকলেও টকির সেই আদি যুগে সাউন্ড ছবির পাশে এই ছবিকে গ্রহণ করলেন না দর্শকেরা। বাণিজ্যিকভাবে প্রবল ব্যর্থ হয় এই ছবি। আর সেই সঙ্গে ওঁর ফিরে আসার সম্ভাবনাও অনেকটা কমে যায়।  

আমরা পথিকৃৎদের স্মরণ করি শুধু তাঁদের ব্যতিক্রমী সৃষ্টির মধ্যে দিয়েই নয় বরং আগামী প্রজন্মের মধ্যে সৃষ্টির এই তাগিদটা জাড়িয়ে তোলার ক্ষেত্রেও তাঁদের একটা ভূমিকা থাকে। এই বক্তব্যের সার্থক রূপ ছিল ওঁর জীবন। চার্লি চ্যাপলিনের প্রথম স্ত্রী মিলড্রেড হ্যারিস, মেরি ম্যাক্লরেন, ক্লেয়ার উইন্ডসরের মত সে যুগের নামী অভিনেত্রী এবং ফ্রান্সেস মেরিয়নের মত চিত্রনাট্যকারকে রীতিমতো গড়ে তুলেছিলেন ল্যুইস। এই ফ্রান্সেস মেরিয়নের সহায়তায় তিনের দশকের শুরুতে আরেকবার হলিউড ইন্ড্রাস্ট্রির মূল স্রোতে এক চিত্রনাট্যকার হিসেবে ফিরেছিলেন ল্যুইস। সেই সময় তাঁর আর একটা দায়িত্ব ছিল কাস্টিং ডিরেক্টর হিসেবে। এই পর্বেই ‘হোয়াইট হিট’ ছায়াছবিতে তিনি শেষবারের মতো পরিচালনার সূযোগ পেয়েছিলেন যার মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেন ‘সিটি লাইটস’ খ্যাত ভার্জিনিয়া চেরিল। 

নিজের কাজের টেবিলে স্রষ্টার আসনে ল্যুইস ওয়েবার (১৩/০৬/১৮৭৯ - ১৩/০৬/১৯৩৯)

 

সময়দেবতার নিষ্ঠুর অনবধানে অনেক শিল্পীই যেমন হারিয়ে যান সংস্কৃতির রঙ্গমঞ্চ থেকে, উত্তর প্রজন্মের স্মরণ থেকে তেমনভাবে হারিয়ে গেছে ওঁর অনেক সৃষ্টি। ল্যুইসের কৃতিত্বের ভাণ্ডারে ছিল প্রায় ১৩৫ টা ছায়াছবি পরিচালনা, ১১৪ টার মতো ছায়াছবির চিত্রনাট্য লেখা এবং প্রায় শ’খানেক ছবিতে অভিনয় করা। সৃষ্টির এই নানারঙের ফুলের তোড়ার মধ্যে হয়তো গোটা কুড়ির মতো ছবি এখন অবশিষ্ট আছে। ১৯৩৯-এর উনিশে নভেম্বর ওঁর মৃত্যুর পরে লস অ্যাঞ্জেলস এক্সামিনার এবং ভ্যারাইটি পত্রিকায় খুব সংক্ষিপ্ত উল্লেখ ছাড়া আর কোথাও এই সংবাদ বেরোয়নি। সেই আমলের বিখ্যাত গসিপ কলামিস্ট হেড্ডা হপার অবশ্য এক মরমী স্মৃতিকথা লিখেছিলেন।

এই রুপোলি দুনিয়ার পাটিগণিতের পিচ্ছিলতায় অনেকদিন বিস্মৃতির আড়ালে ছিলেন ল্যুইস। ডিজিটাল প্রযুক্তির বদান্যতায় আবার ওঁর ছবি নতুন করে রেস্টোর করা গেছে, সিনে বোদ্ধাদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হয়েছে তাই নিয়ে। ২০১৭ সাল থেকে বাফেলো ড্রিমস ফ্যান্টাস্টিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল-এ ওঁর নামাঙ্কিত এক পুরস্কার চালু হয়েছে। একজন সার্থক স্রষ্টা হয়তপ ইতিহাসের ভ্রুকুটি পেরিয়েও সৃষ্টির ব্যপ্ত চরাচরে এভাবেই রয়ে যান শেষমেশ।

Powered by Froala Editor