বইমেলার হৃৎস্পন্দনের খোঁজ, ছ'টি সাম্প্রতিক লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে আলোচনা

আর চারদিন মাত্র বাকি বইমেলা শেষ হতে। মেলার মাঠ তো বটেই, লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নেও উৎসবের আমেজ কিছু কম নয়। বইমেলা আসলে পাঠক আর সাহিত্যিকদের মিলনমেলা। আর অনেক কলমচিরই আঁতুড়ঘর বাংলার লিটল ম্যাগাজিন। এ-বছর প্রহরের কাছে যে-কটি লিটল ম্যাগাজিন জমা পড়েছে, সেগুলির থেকেই নির্বাচিত কয়েকটি নিয়ে আলোচনা করছি আমরা। আজ রইল তেমনই ছ’টি পত্রিকা -

সর্বনাম

সাহিত্যজগতে, বিশেষত লিটল ম্যাগাজিনের বৃত্তে একটা প্রশ্ন প্রায়ই ঘোরেফেরে। পত্রিকাগুলির একটি ‘স্বভাব’ নিয়ে। তা হল, কোনো কবির একটি করে কবিতা প্রকাশ করা। একটি নির্দিষ্ট কবিতা পড়ে কি কোনো কবিকে কখনও চেনা যায়? সেই কবির লিখনশৈলি, প্রকাশভঙ্গি – কোনোকিছুই কি একটিমাত্র কবিতা থেকে চিনে নিতে পারেন পাঠক? সেক্ষেত্রে, গুচ্ছ কবিতা অর্থাৎ একাধিক কবিতা প্রকাশ করাই কি উচিৎ নয়? যাতে সেই কবির লেখা সম্পর্কে আংশিক হলেও ধারণা জন্মায় পাঠকের? বেশ কিছু পত্রিকা এই গুচ্ছ কবিতা প্রকাশের ব্যাপারটিকে স্বীকৃতি দেন। তেমনই একটি পত্রিকা ‘সর্বনাম’। সুপ্রসন্ন কুণ্ডু ও পঙ্কজ চক্রবর্তীর সম্পাদনায়, সর্বনামের সাম্প্রতিক সংখ্যায় ঠাঁই পেয়েছে একাধিক নবীন ও প্রবীণ কবির গুচ্ছকবিতা।

তবে এই সংখ্যাটির সবচেয়ে বড়ো আকর্ষণ সম্ভবত পত্রিকার মধ্যে আস্ত একটি কবিতার বইয়ের উপস্থিতি। কৌস্তভ কুণ্ডুর ‘সেলাই করা শালপাতা’ সত্যিই সম্পাদকদের অভিনব একটি নির্বাচন। সম্পাদকীয়’তে লেখা, প্রতি সংখ্যাতেই এমন একটি করে বই প্রকাশিত হবে পত্রিকার মধ্যে। কৌতূহল জাগায় এমন কাজ।

সর্বনামের এই সংখ্যাটির আরও একটি বড়ো আকর্ষণ শূন্য ও প্রথম দশকের একাধিক কবির কবিতাভাবনা ও নির্বাচিত কবিতার সংকলন। তরুণ প্রজন্মের কবিদের ভাবনার ছোঁয়া পেতে এই অংশটি পাঠককে সাহায্য করবে নিঃসন্দেহে। ভালো লাগে রাণা রায়চৌধুরীর ‘আসলে রমেন বলে কেউ ছিল না’ গল্পটিও।

সুপ্রসন্ন কুণ্ডুর প্রচ্ছদে, সর্বনাম পত্রিকার এই সংখ্যাটি যে পাঠকের মনোগ্রাহী হয়ে উঠবে, তা নিয়ে বিশেষ সন্দেহ করা চলে না বোধহয়।

আচমন (আচার্য ললিতমোহন সেন সংখ্যা)

তিনি মারা গিয়েছিলেন ১৯৫৪ সালে। তারপর কেটে গেছে ৬৬ বছর। বাঙালির স্মৃতি থেকে একপ্রকার মুছেই গিয়েছিলেন তিনি। তরুণ প্রজন্মের অনেকে তাঁর নামের সঙ্গেও পরিচিত নয় হয়তো। কাজ তো অনেক পরের কথা! তিনি, আচার্য ললিতমোহন সেন। সম্প্রতি, আচমন পত্রিকার ‘আচার্য ললিতমোহন সেন সংখ্যা’র হাত ধরে ফিরে এলেন আবার, পাঠকের কাছে।

ললিতমোহন ছিলেন শিল্পী। যদিও শব্দটির বিস্তৃতি অনেকটাই। চিত্রশিল্পে তাঁর অবদান রসজ্ঞমাত্রই স্বীকার করবেন। জীবনের বেশিরভাগ সময় লখনৌ-তে কাটানোয়, নদীয়ার শান্তিপুরের এই ভূমিপুত্র হয়তো বাংলায় পরিচিতিও পাননি বেশি। সম্পাদক গৌরব কেতন লাহিড়ী সেই প্রয়োজনীয় কাজটিই করলেন আচমন পত্রিকার মাধ্যমে।

পত্রিকাটিতে রয়েছে ললিতমোহন সেন সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্যমূলক প্রবন্ধের সমাহার। রয়েছে তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণ, তাঁর লেখা কয়েকটি চিঠি, তাঁর নিজস্ব কিছু লেখা এবং নির্বাচিত কিছু শিল্পকলা।

আচমনের এই সংখ্যাটির অন্যতম আকর্ষণ ললিতমোহনের ১২টি ছবির প্রিন্ট। এবং সেটি পত্রিকার সঙ্গেই বিনামূল্যে পাওয়া যাচ্ছে, একটি খামের মধ্যে। সম্পাদকের এই উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। সৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রচ্ছদে সজ্জিত এই সংখ্যাটি নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় কাজ হয়ে রইল। ভবিষ্যত এর মূল্যায়ন করবেই...

ফারেনহাইট

“যে কোনো শিল্প, কবিতাও শেষ পর্যন্ত হয়তো এক মহান মিথ্যা, যার কাজ আমাদের ওপর জাদুবিস্তার করা সম্মোহিত করা।” – লিখছেন অমিতাভ মৈত্র। প্রশ্ন জাগে মনে, সত্যিই কি তাই? জাদুবিস্তার ও সম্মোহন ছাড়া কবিতার কি কিছুই করণীয় নেই আর? হয়তো আছে। হয়তো নেই। এই দ্বন্দ্বও কবিতারই। সজল দাস যে-কারণে লিখলেন – ‘জলের দোষ নয়, বালিরও নয় / নৌকা এমনিই পড়ে আছে’ – এ কি শুধুই সম্মোহন? না আবহমান অস্তিত্বের খোঁজও তুলে আনে কবিতা?

এই প্রশ্ন জাগল হাতে একটি কৃশকায় পত্রিকা নিয়ে। আক্ষরিক অর্থেই ‘লিটল ম্যাগাজিন’। নাম – ‘ফারেনহাইট’, সম্পাদক – সেলিম মণ্ডল। প্রবল পরিচিতি পাওয়ার কিংবা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার দায় নেই এই পত্রিকার। দায় শুধু পাঠককে ভাবানোর। যে-কারণে মূল্যের বদলে স্পর্ধা দেখাতে পারে এই বলে – ‘দেখিয়া বুঝিয়া দাম দিবেন।’

পাঠকের খিদের কাছে অমূল্য হয়ে উঠতেই পারে দেড় ফর্মার এই ছোট্ট পত্রিকাটি। সজল দাসের গুচ্ছ কবিতা, হিন্দোল ভট্টাচার্যের কবিতা-বিষয়ক প্রবন্ধ, মণীন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত ‘পরমা’ পত্রিকা নিয়ে পৃথ্বী বসুর আলোচনা, কবি গৌরাঙ্গ ভৌমিককে নিয়ে কমলকুমার দত্তের আলোচনা এবং ত্রিস্তান জারা-কে নিয়ে অর্ক চট্টোপাধ্যায়ের বিশ্লেষণ – ব্যস, এতেই পৌঁছে যাওয়া যায় পত্রিকার শেষ পাতাটিতে। অথচ শেষের পরও আরও পড়ার ইচ্ছে হারায় না। আরেকটু পড়া গেলে হত...

সম্বিত বসুর নামাঙ্কন ও সন্তু দাসের প্রচ্ছদে সেজে উঠেছে ‘ফারেনহাইট’। লিটল ম্যাগাজিনের দুনিয়ায় নবতম তাপাঙ্কই বটে! পাঠক বুঝবেন ভালো...

ভাষালিপি

লিটল ম্যাগাজিনের জগতে ‘কবিতার পত্রিকা’র স্থান চিরকালই সম্মানের। বিশেষত সেই সব পত্রিকাগুলি, যারা দীর্ঘদিন ধরে একের পর এক সংখ্যার মধ্যে দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে বাংলার সাম্প্রতিক কবিতাচর্চা। ঠাঁই দিয়েছে নতুন-নতুন কবিদের। তেমনই একটি পত্রিকা ‘ভাষালিপি’। সাম্প্রতিক সংখ্যাও সেই ঐতিহ্যকেই বহন করে চলেছে নিপুণভাবে।

অরুণাভ সরকারের সম্পাদনায়, ভাষালিপির এই সংখ্যাটিতে রয়েছে ৬০ জন কবির কবিতা। রয়েছে গৌতম বসুর অনুবাদে গিলগামেশ মহাকাব্যের অংশবিশেষ, ভূমেন্দ্র গুহ-কে নিয়ে প্রশান্ত মাজী’র স্মৃতিচারণ, ছবি আঁকা নিয়ে হিরণ মিত্রের অনবদ্য একটি গদ্য। আরও আকর্ষণীয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গোরা’ উপন্যাসের একটি অংশের পুনর্মুদ্রণ।

ভাষালিপি কবিতা পত্রিকা হিসেবে পাঠকের সম্মান পেয়েছে দীর্ঘদিন। ধারাবাহিকভাবে ভালো কবিতা পৌঁছে দিচ্ছে পাঠকের কাছে। এই সংখ্যাও তার ব্যাতিক্রম নয়। সামান্য একটি উদাহরণ রইল, কবি বিপ্লব চৌধুরীর কবিতা অংশবিশেষ – “সুধা এলে বিছানার বারণ ভুলে দেয়ালে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে অমলের মন। তুমি তাকে হেসে হেসে দূর পৃথিবীর গল্প শোনাও। / পুষ্পের সৌরভে ভরে ওঠে একটি ইষ্টক-নির্মিত গৃহ।” কবিতার নাম ‘সুধা’।

অপদার্থের আদ্যক্ষর (কবির মৃত্যু)

একজন কবির কলমে কীভাবে ধরা দেয় মৃত্যুচেতনা? কবির মৃত্যু কি সত্যিই আক্ষরিক? না তাঁর ভাবনার মৃত্যুই আসলে মৃত্যু? একজন কবির শেষ জীবন কেমন? কতটা নিঃসঙ্গ? কতটাই বা জন-আলোড়নের মিশে থাকে তাঁর প্রয়াণ? এসব আলোচনা সিরিয়াস পাঠকের মনে কৌতূহল জাগাবেই। আর ‘অপদার্থের আদ্যক্ষর’ পত্রিকার সাম্প্রতিক সংখ্যা সেজে উঠেছে এমনই এক বিষয়ের ক্রোড়পত্র নিয়ে।

গতানুগতিক কবিতা-অণুগল্প-মুক্তগদ্য-গল্পের পাশাপাশি, অপদার্থের আদ্যাক্ষরের ‘কবির মৃত্যু’ নিয়ে লেখাগুলি নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। মির্জা গালিব, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ, সিলভিয়া প্লাথ থেকে শুরু করে শক্তি-বিনয়-ভাস্কর – মোট ১৭ জন কবির মৃত্যু, মৃতুচেতনা ও শেষ জীবন নিয়ে লিখেছেন ১৭ জন। শুধুমাত্র এই বিভাগটির জন্যেই সংগ্রহ করা যায় অপদার্থের আদ্যাক্ষরের সাম্প্রতিক সংখ্যাটি।

প্রণবশ্রী হাজরার প্রচ্ছদে এবং মেঘ শান্তনুর সম্পাদনায়, অপদার্থের আদ্যক্ষরের ‘কবির মৃত্যু’ সংখ্যা এখনও পর্যন্ত পত্রিকাটির সেরা কাজ, তা নিয়ে সম্ভবত আর সংশয় করা চলে না।

বাতিঘর

“নিজেকে ‘না’ বলাতে পারলে আর কোনো অস্ত্রের দরকার হয় না। পাল্টা মারের যে মানসিক প্রস্তুতি তা একেবারেই মনে আসে না তখন। মানুষ নিজেকেই অস্ত্র করে তোলে তখনই, যখন সে তার অহং বা ‘আমি আমি’ ভাব থেকে বেরোতে পারে না। নিজেকে সশস্ত্র করে তোলা খুব সহজ কাজ। কিন্তু নিজেকে নিরস্ত্র করা, সে এক দীর্ঘ শিক্ষার অভ্যাস।’

লিখছেন রাণা রায়চৌধুরী। ‘অস্ত্র যদি কবিতা হয়’ শীর্ষক লেখায়। বাতিঘর পত্রিকার ‘অস্ত্র’ সংখ্যা এমনই একাধিক চমক এনে হাজির করেছে আমাদের সামনে। অস্ত্র নিয়ে লিখেছেন একাধিক লেখক। কারোর লেখায় ফুটে উঠেছে ভারতের প্রাচীন মুদ্রায় খোদিত অস্ত্রের কাহিনি, কেউ বা আলোচনা করেছেন মহাভারতে বর্ণিত বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে। বাদ পড়েনি রামায়ণও। রবীন্দ্রনাথের লেখায় সহিষ্ণুতা ও অস্ত্র, যা আসলে কবিরই এক ভিন্ন চেহারা, আলোচিত হয়েছে অত্যন্ত যত্ন সহকারে। ভালো লাগে সৌমেন নাথ, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, রাজা ভট্টাচার্য, অভীক ভট্টাচার্য, মিথিল ভট্টাচার্য প্রমুখের লেখা।

সন্মাত্রানন্দের অনুবাদে ভর্তৃহরির কবিতা ও তার আলোচনা এই সংখ্যার অন্যতম সম্পদ। নজর কাড়ে বিশেষ রচনা ও কবিতাগুলিও। রাতুল চন্দরায় ও অনির্বাণ দাসের সম্পাদনায়, রাতুল চন্দরায়ের নিজেরই প্রচ্ছদে বাতিঘরের এই ‘অস্ত্র’ সংখ্যাটি নিঃসন্দেহে একটি ব্যতিক্রমী ও সংগ্রহযোগ্য কাজ।

More From Author See More