হিন্দি আগ্রাসন ও ভাষা-রাজনীতি : প্রশ্নের মুখে দেশের সম্প্রীতিও?

ইতালীয় ভাষায় একটি শব্দ আছে, ‘লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা’। এর অর্থ হল, বিভিন্ন ভাষার সংমিশ্রণ। মোটামুটি দ্বাদশ থেকে বিংশ শতাব্দী, এই সময়ের পরিধিতে ইতালি, ফরাসি, তুর্কি এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের বেশকিছু ভাষার একটি মিশ্রিত রূপকেই নাম দেয়া হয়েছিল ‘লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা’। অভিধানে এর অর্থ করা হয়েছিল, একটি দেশের বাসিন্দা নিজস্ব মাতৃভাষা ছাড়াও অন্য যে ভাষা অপরের সঙ্গে কথাবার্তা বা ভাব বিনিময় করার জন্য ব্যবহার করেন, তাকেই বলা হয় লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা। ঠিক এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বর্তমানে ভাষা নিয়ে ভারতের রাজনৈতিক বিন্যাসের সমীকরণটিকে আলোচনা করা যায়।

ভাষা নিয়ে জোর জবরদস্তি করে অন্যের উপর তা চাপিয়ে দেওয়া নিঃসন্দেহে এক ধরনের আধিপত্যবাদী রাজনীতিকেই নির্দেশ করে, যেখানে শুধু ভাষার প্রেক্ষিতেই যেন তৈরি করতে চাওয়া হয় সমান্তরাল একটি সাম্রাজ্য। সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার হিসেবে ভাষাকে ব্যবহার করার দৃষ্টান্ত একদম নতুন কিছু অবশ্যই নয়। স্বাধীনতার পর ভারত ভূখণ্ড ভাগ হয়ে তৈরি হওয়া নতুন দেশ পাকিস্তানের পূর্ব এবং পশ্চিম অংশের মধ্যে যে বিবাদ লেগেছিল, তার মূল ভিত্তি ছিল কিন্তু ভাষাই। জাতীয় ভাষা হিসেবে উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার আগ্রাসী রাজনীতি মেনে নিতে পারেননি পূর্ব পাকিস্তান বা অধুনা বাংলাদেশের নাগরিকেরা। যার ফলে জন্ম নেয় নতুন আবেগ এবং তার ফলশ্রুতি হিসেবে, নতুন বাংলাদেশ। সুতরাং, ইতিহাস সাক্ষী, ভাষার দিক থেকে সংখ্যালঘুদের বরাবরই ভাষাগত সংখ্যাতত্ত্বে এগিয়ে থাকা জনজাতির এই চাপিয়ে দেওয়া বা দখল করে নেওয়ার বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। কারণ কে না জানে মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধের সমান, এবং সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চাইলে আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভোগাটাই খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়।

ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী ভারতের কোনও রাষ্ট্রভাষা নেই। হিন্দি এবং ইংরেজি ভারত সরকারের ‘অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ’ বা ‘দাপ্তরিক ভাষা’। অর্থাৎ সরকারি কাজকর্মে এই ভাষা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যদিও রাজ্যগুলির সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আছে তাদের নিজস্ব সরকারি ভাষা ঠিক করার। তবে ওই ‘লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা’ যুক্তিতে দেখলে, ভারতে মোটামুটি ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ মানুষ হিন্দিতে কথা বললেও, ৪৫ শতাংশ ভারতীয় হিন্দি বলতে বা বুঝতে, অর্থাৎ হিন্দিতে ‘কমিউনিকেট’ করতে পারেন। এরই সুবিধা নিয়ে হিন্দিকে ভারতের প্রধান ভাষা হিসেবে তুলে ধরার একটি চেষ্টা চলছে বহুদিন ধরেই।

কিন্তু সারা ভারতের অহিন্দীভাষী অংশ থেকে, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতের জোরালো প্রতিবাদে কখনোই সাফল্য পায়নি সেই প্রচেষ্টা। ভারতের স্বাধীনতা পাওয়ার আগেই হিন্দি ভাষার এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামিল হয় দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলি। পরবর্তীকালে ১৯৬৫ সালে দাক্ষিণাত্যের হিন্দি বিরোধী আন্দোলনের সামনে মত বদলাতে বাধ্য হয়েছিলেন জওহরলাল নেহেরুও। দেশবাসীদের সামনে জানিয়েছিলেন, কখনোই হিন্দি কারুর উপরেই জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হবে না।

তবে আবার কেন প্রসঙ্গ উঠছে এই ভাষার আগ্রাসন অথবা সাম্রাজ্যবাদী রূপ নিয়ে? পূর্ববর্তী ইউপিএ জোটকে সরিয়ে ভারতের বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরেই এই একটি বিশেষ প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে সারা দেশ জুড়েই। হিন্দি ভাষার আগ্রাসন নিয়ে লাগাতার সরব হতে হয়েছে দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলির সঙ্গে বাংলা, আসাম বা ত্রিপুরার মতো রাজ্যগুলিকেও। এমনকি গত বছরে ‘হিন্দী দিবস’ উপলক্ষে বর্তমান ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ তো মন্তব্য করেই বসেছিলেন যে, ভারতের একটি জাতীয় ভাষা থাকা প্রয়োজন! কিন্তু সেই নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়ে থিতিয়ে যাওয়ার পরেই সদ্য সামনে আসা কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন শিক্ষানীতি সেই বিতর্কে ঘি ঢালল আবার। এই শিক্ষানীতিতে শিক্ষার গৈরিকীকরণ করার অভিযোগ উঠেছে প্রবলভাবে। দেশের সমস্ত রাজ্যগুলিতে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করতে বলা হয়েছে হিন্দিকে। স্বাভাবিকভাবেই এর বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলি। সরব হয়েছে পশ্চিমবঙ্গও। এই নতুন শিক্ষা তথা ভাষা নীতির পিছনে সরকারের মেরুকরণের রাজনীতি কাজ করছে বলে দাবি বিরোধীদের। উল্টোদিকে সরকারি নীতির সমর্থকরা দাবি করেছেন সেই চিরাচরিত ভুল যুক্তিতে, যে রাষ্ট্রভাষা হিন্দি শিখতে আপত্তিটা কোথায়!

কেন্দ্রের এই নীতির বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনীতি শিবির থেকে জোরদার প্রতিবাদের মাঝেই মারাত্মক অভিযোগ এনেছেন ডিএমকে দলের নেত্রী কানিমঝি। বিমানবন্দরে হিন্দি বলতে না চাওয়ায় তার নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সিকিউরিটি অফিসার, অভিযোগ কানিমোঝির। তাই উত্তপ্ত হওয়া পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারের, বিশেষ করে দাক্ষিণাত্য থেকে নির্বাচিত উল্লেখযোগ্য নেতা-মন্ত্রীরা দেশবাসীকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছেন। ড্যামেজ কন্ট্রোলের মতোই তাঁদের বলতে শোনা গেছে যে, এই নয়া শিক্ষানীতি এবং ভাষা হিসেবে হিন্দি কখনোই কোনও রাজ্যের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হবে না। ভোল পাল্টে কেন্দ্র এবং রাজ্যের সমন্বয়ের কথাও বলেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এর ফলে দেশবাসীদের একে অপরের প্রতি যে তিক্ততা তৈরি হচ্ছে, তা আদতেই কোনও সুস্থ ভবিষ্যতের দিকে নির্দেশ করতে পারে না। তাই অবিলম্বে সরকারের আশ্বস্ত করা উচিত সমস্ত দেশবাসীকে। ভাষার অধিকার সুরক্ষিত করাও সরকারের আশু কর্তব্যের মধ্যে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ একটি, এ কথা তাই অনস্বীকার্য এখন। 

আরও পড়ুন
হিন্দি সিনেমায় ব্যর্থ হলেন ‘বহিরাগত’ উত্তমকুমার, ষড়যন্ত্রে জড়িত বলিউডের রথী-মহারথীরাও?

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Powered by Froala Editor

More From Author See More