দুর্গাপুজোয় খরচ ১৭ টাকা, শক্তি-আরাধনা করেই কপাল ফিরল সাহেবের

পূজার গল্পে যেটা আসবেই, সেটা হল পূজার ফর্দের কথা। আরবি ফরদ থেকে আসা এই শব্দের মানে তালিকা। নবাবি আমলে ফারসি ভাষাই প্রধান ছিল, তখন থেকেই এ-শব্দ বাংলায় এসেছে।

দুর্গাপুজোর ফর্দ লেখা হত লাল কালিতে। তুলোট কাগজে। মোট ১৩টি ভাগে বানানো হত এই ফর্দমালা। বিভিন্ন দ্রব্যাদির ভাগগুলো হল— কল্পারম্ভ, নবপত্রিকা, বোধন, আমন্ত্রণ, অধিবাস, সপ্তমী, মহাস্নান, হোম, অষ্টমী, সন্ধিপূজা, নবমী, দশমী-র দ্রব্য এবং অন্যান্য দ্রব্য। দুই পুরাণ মতে এই ফর্দ তৈরি করা যেত— কালিকাপুরাণ ও বৃহন্নন্দিকেশরপুরাণ মতে। এই ফর্দের ভাষায় সংস্কৃত ভাষার উল্লেখ দেখা যেত প্রায়ই।

ফর্দ হত মোটামুটি এই রকম—

প্রতিপদে মাথাঘষা, সুগন্ধ তৈল, চিরুনি, দ্বিতীয়াতে মাথায় বাঁধার পট্টডোর, তৃতীয়াতে দর্পণ, সিঁদুর আর অলক্তক, চতুর্থীতে মধুপর্ক— এই রকম। আর মাথায় লেখা থাকত, ‘শ্রী শ্রী দুর্গামাতা সহায়’। .

আরও পড়ুন
দুর্গাপুজোর পদ্ধতি নিয়ে শাক্ত-বৈষ্ণবে বিবাদ, সমাধান মিলল সিংহে

সাহেবরা হিন্দুদের দুর্গাপুজোতে যেতেন যেমন, তেমনি নেটিভ হিন্দুরাও সাহেবের পুজোতে গেছেন, এমন গল্পও ঘটেছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহেব ছিলেন জন চিপস। ব্যবসাদার। একবার ব্যবসায় ভাঁটা পড়ল। সাহেবের মাথায় হাত। সে সময় তাঁর এক বাঙালি বন্ধু বুদ্ধি দিলেন দুর্গাপুজো করার। করলেন। সেবার দ্বিগুণ লাভ হল।

আরও পড়ুন
‘গড সেভ দ্য কিং’ গান দিয়ে শুরু দুর্গাপুজো, খাবারের আয়োজনে ক্যাটারার!

সেই থেকে সাহেব প্রতি বছর ধুমধাম করে পুজো করতেন। খরচ হত ১৭ টাকা। কাঙালি ভোজন, বস্ত্র বিতরণের খরচা আলাদা। দুর্গাপুজোয় ফোর্ট উইলিয়াম থেকে দাগা হত তোপ। কোম্পানির ফৌজ দেবীর মুখোমুখি হলেই সেলাম জানাত ফৌজি কায়দায়।

আরও পড়ুন
পাথরের মূর্তি বদলে গেল মৃন্ময়ীতে, পেখম মেলল চালচিত্র

তখন বাংলার গ্রামেগঞ্জে দুর্গার কতই না নাম। আর স্থানে স্থানে কালে কালে তাঁর বাহুর সংখ্যা বদলায়। নামও ছিল কত রকম। ভাণ্ডারনী, গুরগুড়াই, সিদ্ধেশ্বরী, নন্দেশ্বরী, মারাংবুরু, শাকম্ভরী, গুপ্তমণি, বুড়িমা এমনকি পেটকাটি। এই শেষের নামে দেবী পূজিতা হন মুর্শিদাবাদের গদাইপুরে। মহিষাসুরের পেট কেটেই এই নাম ধারণ তাঁর। দেবীর এই হাতের সংখ্যা নিয়েও জাঁক হত। কৃষ্ণনগরের সিংহাসনে তখন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। তাঁর বাবার আমলের মন্ত্রীর নাম কৃষ্ণরাম সেন। দুজনেই ঘটা করে দুর্গাপুজো করতেন। এই পুজো নিয়েই চরম গোল বাঁধল। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পুজোর ভিড় ছিল দেখার মত। একবার তাতে কিছু কম পড়ল। রাজা খবর নিয়ে জানলেন নেদিয়াপাড়ায় মন্ত্রী কৃষ্ণরাম এবার দশভুজা না, চতুর্ভুজা না, একেবারে ত্রিভুজা এক দুর্গা করেছেন। সবাই দলে দলে গিয়ে সেটা দেখছে। রাজা অপমানিত হয়ে মন্ত্রীকে বরখাস্ত করলেন। শুধু তাই না, গ্রেপ্তারও করলেন। খেতে দিতেন নাকি শুধু শালিধান। ছেলে রামচন্দ্র সরাসরি যোগাযোগ করলেন নবারের সঙ্গে। আর ক্রমে ক্রমে সেই ঘটনার শেষ হল প্রজা বিদ্রোহে। জড়িয়ে পড়লেন নবাবরা। যুদ্ধ অবধি হয়েছিল। কৃষ্ণচন্দ্র হার স্বীকার করলেন। এক নদীয়ায় দুই কৃষ্ণ থাকতে পারে না। তাই রায়রায়ান উপাধি নিয়ে কৃষ্ণরাম বাধ্য হয়ে সোমড়ায় চলে এসে নিজের প্রাসাদ বানালেন। সঙ্গে দুর্গা মণ্ডপ। সেখানে এখনও পূজিত হন সারা বাংলার একমাত্র ত্রিভুজা দুর্গাপ্রতিমা।

Powered by Froala Editor