‘এই সময়ে দাঁড়িয়ে সকলের মধ্যে প্রেম বিলানো একটা বড়ো কাজ’: ইমন

সদ্য একপশলা বৃষ্টিতে বিচ্ছিরি গুমোট ভাবটা খানিক কেটেছে। কিছুক্ষণ আগেই হোয়াটস্যাপে মেসেজ এসেছিল, “একটু দেরি হবে। প্লিজ কিছু মনে কোরো না। ১৫ মিনিট।” ১৫ মিনিটও অপেক্ষা করতে হয়নি অবশ্য। ফোনের ওইপ্রান্তে থাকা মানুষটার গলায় কখনও স্বভাবসিদ্ধ উচ্ছলতা, আন্তরিকতা চুঁইয়ে নামছে বারবার। লিখিত ইন্টারভিউতে কবেই বা এইসব ধরা পড়েছে! তিনি ইমন, ইমন চক্রবর্তী। দু’দিন আগেই প্রকাশ পেয়েছে তাঁর গাওয়া নতুন রবীন্দ্রসংগীত, “এ কী লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ।” কথা বলতে বলতে মনে হচ্ছিল, সাক্ষাৎকার নেওয়ার এর চেয়ে ভালো উপলক্ষ আর কীই বা হতে পারত!   

গানের প্রসঙ্গ দিয়েই কথা শুরু হোক, নাকি!

ইমন: হ্যাঁ হ্যাঁ, একদম।

এই যে আপনার নতুন রবীন্দ্রসংগীত ‘এ কী লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ’ প্রকাশিত হল, সময়টা শেষ-বর্ষা। শরৎ এখনও আসেনি। আসব-আসব করছে। এমন সময়ে বসন্ত সমাগমের গান কেন?

আরও পড়ুন
বড়োপর্দার মতো ওটিটি-তেও স্বাধীন পরিচালকদের লড়েই জায়গা করে নিতে হবে: রঞ্জন ঘোষ

ইমন: প্রথমত, গীতবিতানে 'লাবণ্যে পুণ্য...' কিন্তু বসন্তের গান নয়। এটা প্রেম পর্যায়ের গান। রবীন্দ্রনাথের গানকে আলাদা করে প্রেম, প্রকৃতি, পূজা পর্যায়ে তো সেইভাবে ভাগ করাও যায় না। যেকোনো গানেই পূজা থাকে। যেকোনো গানেই প্রেম থাকে। তাছাড়া বসন্ত মানেই তো প্রেম। প্রেমের কোনো নির্দিষ্ট ঋতুও হয় না। আমার মনে হয় যে, এই সময়ে দাঁড়িয়ে সকলের মধ্যে প্রেম বিলানো একটা বড়ো কাজ। আমরা সকলেই একটা খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি, তাই এই গানটা বেছে নেওয়া।  


আরও পড়ুন
দেশের কাজে, সমাজের কাজে সোমেন চন্দের ত্যাগ, ঐকান্তিকতা প্রশ্নাতীত : দিলীপ মজুমদার

খারাপ সময়ের কথা বললেন। এই অতিমারী, লকডাউন, কোভিড, বন্দিত্ব এই সবকিছুর মধ্যে ‘লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ’-এর ব্যঞ্জনা আপনার কাছে ঠিক কেমন? আপনার কাছে ‘লাবণ্য’ ঠিক কী?  

ইমন: এই গান বেছে নেওয়ার অন্যতম কারণ ছিল, মনের আনন্দটাকে ধরা। এখানে সেই লাবণ্যকে বোঝানো হয়েছে যেটা মন থেকে আসে, আমাদেরকে ভাবায়। লাবণ্য মানে এখানে সেই জেল্লাটা। যেটা থেকে বোঝা যায় ‘আই অ্যাম হ্যাপি’। সেই হ্যাপিনেসটা আমার কোথা থেকে আসে, সেটাকেই দেখানোর চেষ্টা করেছি। গানটায় এক জায়গায় দেখানো হচ্ছে আমি ঘুঙুর পরছি, কারণ আমি নাচতে খুব ভালোবাসি। এক জায়গায় দেখানো হচ্ছে আমি কোলে ছাগলছানা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, প্রকৃতির কাছে যাচ্ছি। এটাই আমার কাছে ভালোবাসা। এটাই আমার কাছে লাবণ্য। 

আপনি তো রীতিমতো নাচের চর্চা করেন। ওড়িশি শিখছিলেনও। নৃত্যশিল্পী ইমনকে আমরা কবে দেখতে পাব?

ইমন: একদমই দেখবে না। আসলে কিছু কিছু জিনিস নিজের জন্য থাকে তো। এটা বোধ হয় আমার একেবারেই নিজের জন্য। এটা একেবারেই আমি প্রকাশ করতে চাই না যে আমি কতটা ভালো নাচি বা কতটা খারাপ নাচি। যখন আমার খুব টায়ার্ড লাগে, কষ্ট হয়, ক্লস্ট্রোফোবিক লাগে তখন নাচটা উপশম আমার কাছে। আমি ওষুধ হিসেবে এটাকে ব্যবহার করি। এমনকি, গানের থেকেও বেশি।

বেশ। আচ্ছা, এই নতুন গানের ভিডিও-পরিকল্পনাটাও অন্যরকম। প্রথমত পুরো ভিডিওটা জুড়েই আপনি রয়েছেন। এবং যেভাবে আছেন সেইভাবে ইতিপূর্বে আপনাকে কোনো ভিডিওতে দেখিনি। একটা উনিশ শতকের বা সাবেক কলকাতার অন্দরমহলের একটা আবহ। তারপর কিছুক্ষণের জন্য এসেছে একজন তরুণী যে উচ্ছ্বল, এক্কা-দোক্কা খেলছে, কোলে ছাগলছানা। তারপর নর্তকী ইমন। এই যে বিভিন্ন শেড দিয়ে তৈরি হচ্ছে ভিডিওটা। আপনাকেই একভাবে উদযাপন করেছে যেন। গান তো গানের জায়গায়, কিন্তু মিজিক ভিডিও বলতেই যুক্ত হয় দৃশ্যায়ন, পরিবেশনা এবং অবশ্যই অভিনয়। এইটা তো সে অর্থে আপনার চেনা মাঠ নয়। অভিনয় আপনার কাছে কেমন চ্যালেঞ্জিং ছিল? কয়েকদিন আগে অন্যত্রও অভিনয় করেছেন। এই অভিনেত্রী ইমনের জার্নিটা যদি একটু বলেন, বিশেষত এই ভিডিওটাকে কেন্দ্র করে...

ইমন: অভিনয় তো গানের ক্ষেত্রেও থাকে না ভীষণভাবে। অভিনয় মানে তো এক্সপ্রেশন। ভেতরে তুমি যেটা ফিল করছ সেটাকে এক্সপ্রেস করা। আর ছোটো থেকেই এই বিষয়টা আমার মধ্যে ছিল। একটা অভিনয়প্রীতি ছিল আমার মধ্যে। তাই নিজেকে বোঝাতে আমার কোনোদিনই খুব একটা অসুবিধা হয়নি। সেটায় আলাদা করে শ্রম দিতে হয়নি। এক্সপ্রেশনগুলো সহজাতভাবেই এসেছে।

আপনার প্রত্যেকটা পারফর্মেন্সেই এক্সপ্রেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রেও মনে হচ্ছিল, দুঃসময়কে পেরিয়ে যাওয়ার তাগিদ, নিজেকে উদযাপন, একটা ভেতরের স্পিরিট বারবার ফুটে উঠছে... 

ইমন: এর ক্রেডিট আমি সবার আগে দেব নৃত্যগুরু শর্মিলা বিশ্বাসকে। কারণ গানটির অ্যারেঞ্জমেন্টটা নীলাঞ্জন যেভাবে করেছে, সেটা পুরো শোনার পর ভিডিওটা ঠিক কীভাবে ডিজাইন করব আমরা বুঝতেই পারছিলাম না। এই অ্যারেঞ্জমেন্টের সঙ্গে খোলা মাঠের ধারে হাত নেড়ে গান গাওয়ার দৃশ্য বোধহয় একদমই যেত না। সেটা গান গাওয়াটার সঙ্গেই হোক বা গানের মুভমেন্টটার সঙ্গে। সে কারণেই আমি সাহায্য চাইতে শর্মিলাদির কাছে গিয়েছিলাম। উনিই নিলয়দার নাম বললেন, ওঁর সবচেয়ে পুরোনো ছাত্রদের একজন। ফলাফল তো আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন। এই ভিডিওর পিছনে অল ক্রেডিট গোস টু নিলয়দা। অসাধারণ কাজ করেছে, করিয়ে নিয়েওছে। আর আমি নিজে শর্মিলাদির কাছে শিখেছিলাম বলেই ওঁকে গিয়ে বলতে পেরেছিলাম। কনসেপ্টটার ক্ষেত্রেও খানিকটা শর্মিলাদির প্রভাব রয়েছে।

আপনার সাম্প্রতিক যে গানগুলো বেরিয়েছে যেমন ‘পরদেশী মেঘ’, ‘রেত ভারি’, ‘বন্দে মাতারম’— সেগুলো যদি আমরা খেয়াল করি, তবে দেখব প্রত্যেকটা আলাদা আলাদা জঁরের। সেখানে রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়াও নজরুলগীতি এসেছে, গজল এসেছে। এই যে এক জঁর থেকে আরেক জঁরে যাওয়া-- এটা তো যেকোনো শিল্পীর কাছে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং। এই এক্সপেরিমেন্ট করা কেন বারবার? সেটা কি নিজেকে আবিষ্কারের জন্য? নাকি আপনি মনে করেন শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীত কিংবা লোকগীতিতে নিজেকে আটকে রাখাটা ঠিক নয়?

ইমন: এক্সপ্লোর করাটাই বোধ হয় একজন শিল্পীর প্রধান কাজ। আর বিভিন্ন জায়গায় গান করতে গেলে যেটা সবার আগে দরকার সেটা হল ইচ্ছে এবং শিক্ষার জায়গাটা। আমি যে প্রচুর জানি, সেকরম কিচ্ছু নয়। আমি একজন শিক্ষার্থী এখনও। তবে আমি আমার গুরুদের আশীর্বাদে সেই সাহসটা সবসময় পেয়েছি। 

এটা কিন্তু খুব সাধারণ সাহস নয়। এখন তো সমাজে ট্রোল একটা আলাদা ফেনোমেনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানে নরুলগীতি, গজল গাওয়ার ক্ষেত্রে আপনার সামান্য এক্সপেরিমেন্ট নিয়েও শোরগোল পড়ে যেতে পারে। তুলনায় অচেনা ময়দানে খেলতে ভয় লাগে না? 

ইমন: আসলে, তুমি যদি জানো যে তুমি চাইছ সেটা করতে পারবে, তাহলে আর ভয়টা থাকে না। সাহসটা তখন নিজের থেকেই চলে আসে। আমি জানি, আমাকে যেটা শেখানো হবে সেটা আমি শিখে নিতে পারব। পারফর্মও করতে পারব। আমি ওভার কনফিডেন্স থেকে বলছি না, তবে একটা কনফিডেন্স তো থাকতেই হয় নিজের মধ্যে। সেটা থেকেই বলছি আমি যতটুকু শিখেছি, আমি ততটুকু নিয়ে ঝাঁপাতে পারি। ফলে, অত ভয় লাগেনি (হাসি)। 

আপনি বলছেন, যে আপনাকে যেভাবে শেখানো হবে সেইভাবে আপনি উপস্থাপনা করতে পারবেন। তবে, আপনার প্রতিটা গানেই কিন্তু আপনার সিগনেচার স্টাইলটাও দিব্বি আছে। শুনলেই বোঝা যায় ইমন গাইছেন। সেটা শুধু ভয়েসের জন্য নয়, গাওয়ার ভঙ্গীর জন্যেও। এটা কিন্তু শিক্ষার বাইরের জায়গা... 

ইমন: কী জানো তো, এটাও খুব স্বাভাবিকভাবেই এফোর্টলেসলি এসেছে আমার মধ্যে। আমি কিছুই চাপিয়ে দিইনি। আমি যেরকম ঠিক সেইরকমভাবেই এসেছে গানটা। সেটা ভালো, খারাপকে ডিনোট করে না। তবে শিক্ষাটাই আমাকে কনফিডেন্স দেয়। জানাটা একটা সাহস দেয়। আর এটা আমি বলতে পারি যে কাজ করার ক্ষেত্রে আমি এমন কিছু সতীর্থদের পেয়েছি, সেটাও একটা বিশাল পজিটিভিটির জায়গা।

নীলাঞ্জন ঘোষ তাঁদের মধ্যে অন্যতম নিশ্চয়ই?

ইমন: একদম। এই লকডাউন পিরিয়ডটায় ও সাংঘাতিক সাহায্য করেছে আমাকে। প্রত্যেকটা কাজের জায়গায়। এমন প্রতিভাবান মানুষ আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে আছে, এটাই একটা খুব নিশ্চিন্তের জায়গা। যার কাছে কোনো গান নিয়ে গেলেই তা ম্যাজিক হয়ে যায়। 

‘ইমন চক্রবর্তী প্রোডাকশন’-এর পরিকল্পনাটা কীভাবে এল?

ইমন: এটাও কিন্তু লকডাউনেরই ফসল। আর এই বুদ্ধিটাও নীলাঞ্জনই আমাকে দিয়েছে। আমরা নতুন ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কাজ করছি। আমাদের ইউটিউবে ১৮২ হাজার সাবস্ক্রাইবার। নতুন ছেলেমেয়েরা যারা কাজ করতে চায়, তাদের জন্য আমাদের প্ল্যাটফর্মটা খুলে দিয়েছি। তারা চাইলে আমাদের সঙ্গে ইনহাউস কাজ করতে পারে। বা তারা বাইরে থেকেও বিভিন্ন কন্টেন্ট এনে দিতে পারে, যা আমরা ইউটিউব থেকে, প্রোডাকশন হাউসের পেজ থেকে পাবলিশ করব। এবং করছিও। বেশ কয়েকটা করেছি। এবং সমস্ত মিউজিক স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলোতে তাদের গান আমরা তুলে দেব। নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের সঙ্গে নিয়ে এগোনোর একটা চেষ্টা বলতে পারো।

এবার একটা অন্য প্রসঙ্গে আসি। করোনা, অতিমারীর প্রভাবে আমরা সবাই কমবেশি প্রভাবিত হয়েছি। হয়েছি। একজন শিল্পী হিসাবে সেটা নিশ্চয়ই আপনিও হয়েছেন। আমি সেই বিষয়ে আসব না, যে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন। তবে যে একটা বদল এসেছে আমাদের জীবনে, বিশেষত পেশাদারদের কাছে, যাঁরা পারফর্মিং আর্টের সঙ্গে যুক্ত। তাঁরা মঞ্চে গিয়ে গাইতে পারছেন না, দর্শকদের সঙ্গে সরাসরি মেলবন্ধন ঘটাতে পারছেন না। কনসার্ট হলেও হচ্ছে ই-কনসার্ট। এই বদলটাকে কী মনে হচ্ছে? কতটা মানিয়ে নিতে পেরেছেন এটার সঙ্গে? এটা কতোটা স্থায়ী প্রভাব ফেলল পারফর্মেন্সের জগতে? 

ইমন: স্থায়ী প্রভাব তো অবশ্যই ফেলেছে। এটাকে মানিয়ে নেওয়া হয়েছে কতটা, আমি জানি না। তবে জানি এটাকে মানিয়ে নিতে হবে। বদলকে এভাবেই মানিয়ে নিতে হবে। যখন প্রথম ব্যাপারটা হয়েছিল তখন আমার দিশেহারা মনে হচ্ছিল নিজেকে। তারপর শেষ পর্যন্ত একটা জিনিস ভাবি, যেটা চলে গেছে সেটা চলে গেছে। তবে কিছু জিনিস আছে। সেগুলোকেই কাজে লাগাতে হবে। সেভাবেই নিজের কাজগুলোকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। থেমে থাকার কোনো প্রশ্নই উঠছে না। থেমে থাকার কোনো বালাই নেই আমার। 

নিও-নর্মালে ই-কনসার্টগুলো গুণমানের কাছে কম্প্রোমাইজ বলে আপনার কখনো মনে হয়েছে?

ইমন: এটা বলা যায় না হয়তো। মানুষ গান শুনবেনই। পারফর্মেন্স দেখবেনই। নিও-নর্মালে কনসার্ট আর্টিস্টরা নিজে থেকে অ্যারেঞ্জ করেননি। সেটা দর্শকরা চাইছেন বলেই তাঁরা করছেন। সুতরাং যখন শ্রোতারা শুনতে চাইছেন তখন সেটা করব না কেন? আর গুণগত মান সেখানে কম্প্রোমাইজড হচ্ছে বলে আমার মনে হয় না। তবে কমফোর্টের জায়গাটা অবশ্যই কম্প্রোমাইজড হচ্ছে। স্টেজে দৌড়ে, লাফিয়ে গানটা করতাম। বহু মানুষের হাততালি, সেটার জন্য তো গানটা করতাম, সেই জায়গাটা মিস করছি। তবে আমার বিশ্বাস, স্টেজ পারফর্মেন্সের জায়গাগুলোও আস্তে আস্তে খুলবে। তবে সেটা যে এক্ষুনি হবে, তেমনটা আমি ভাবছি না। নিজেদের একটু সময় দিতে হবে। কিন্তু আমার এটাই বক্তব্য যে হাতের সামনে যেটা আছে, সেটাকেই নিয়েই চলতে হবে। বাড়িতে মনখারাপ করে বসে থাকলে কোনো কাজের কাজ হবে না। 

কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ থেকে একটি সম্মাননা পেয়েছেন আপনি। এবং সেটা গানের জন্য নয়। লকডাউনের মধ্যেও আমরা আপনার ফেসবুক লাইভ দেখেছি। সেখানে প্রচণ্ড বৃষ্টি পড়ছে, তাও আপনি বেরিয়েছেন। পাড়ার কুকুরছানা, বেড়ালছানাদের খাওয়ার দেওয়া। এই যে একজন অন্য ইমন। সেলিব্রিটি মনের বাইরে একজন। যিনি বেড়াল, প্রাণী এদেরকে নিয়ে থাকেন; তাদের কথা ভাবেন। পারফর্মার ইমনের থেকে এই ইমন কতটা আলাদা? নাকি দু’জনেই একই?

ইমন: পারফর্মার ইমন বা সিঙ্গার ইমন সেটা একেবারে আলাদা। সেটা প্রফেশনাল জায়গা। সেখান থেকে আমি টাকা পয়সা ইনকাম করি, সেটা দিয়ে আমি জীবনযাপন করি। সেটা আমার কাজের মধ্যে পড়ে। তুমি নিজের কথাই ধরো, একটা পোর্টাল চালাও, বা যখন পড়াতে-- এই অনিতেশ আর ব্যক্তি অনিতেশের জায়গাটা তো আলাদা। সেলিব্রিটি জীবনটাও আমি প্রফেশনাল জায়গা থেকেই দেখি। তারপর সবাই আমার বন্ধু। নাড়ু, যে আমার গাড়ি চালায়, সে আমার বন্ধু। প্রিয়া, যে আমাকে ম্যানেজ করে সেও আমার বন্ধু। আমি এদেরকে বন্ধু বলে মনে করি। ইন্ডাস্ট্রিতে আমার হাতে গোনা দু’-তিনজন বন্ধু আছে। সুতরাং পাড়ার দোকানে বসে চা খাব, ঘুরতে যাব, আড্ডা মারব, লোকাল ট্রেনে চাপব, ওইটাই আমি। ওটার সঙ্গে যদি সেলিব্রিটি ইমনের ক্ল্যাশ করে যায়, তবে মানুষ ইমনটা কোথায় যাবে?

একদমই। তবে আমার প্রশ্নটা ঠিক করা হল না। আসলে ‘লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ’ যে ভিডিওটি প্রকাশিত হয়েছে, সেটি স্ক্রিপ্টেড, কোরিওগ্রাফড। কিন্তু সেখানে আল্টিমেটলি ইমনকেই একভাবে বের করে আনার চেষ্টা হয়েছে। এবং সেখানে যে এক্সপ্রেশন, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত ইমন, সিগনেচার ইমন, পারফর্মার ইমন যিনি অভিনয় করছেন, নাচের মধ্যে রয়েছেন। এইগুলো কোথায় জড়িয়ে? কোথায় এক?

ইমন: এগুলোই তো ইমন। মানে ধরো আমার লিখতে ইচ্ছে হল আমি লিখলাম। আমার কোনো অভিযোগ করতে ইচ্ছে করছে আমি সেটা করলাম। যেটা ভালোলাগছে সেটাই আমি করব। এবং ‘আই আম নট আনসারেবল টু এনিবডি’। আর আমি ভীষণ লাকি, যে আমার যেটা ভালোলাগে সেটা আমার শ্রোতাদেরও ভালোলাগে। সেটাই আমাকে সেলিব্রিটি ইমন করে তোলে। বুঝতে পেরেছ? তাছাড়া ওটাও ইমন, আবার যে পাড়ার কুকুরছানাদের খাওয়াচ্ছে সেও ইমন। সবটা মিলিয়েই আমি। দোষ-গুণ মিলিয়ে একেবারে সাধারণ মানুষের মতোই।

আপনি কি ইমেজ কনসার্নড? 

ইমন: নট অ্যাট অল।

আপনার যদি একটা বাঁধা-ধরা ইমেজ তৈরি হয়ে যায় একটি বা একাধিক বিখ্যাত মিডিয়ার থ্রুতে। যেভাবে এখন ইমেজ তৈরি হচ্ছে। অবশ্যই আপনার দক্ষতা, গানের বাইরেই। শিল্পীর নিজের দক্ষতার জায়গার বাইরেও যদি তৈরি হয়, সেটা কি আপনার মনে হয় যে না হলেই ভালো হত বা এটা ঠিক হচ্ছে? এটা নিয়ে আপনি চিন্তিত?

ইমন: আমি যে সেটাকে একদমই উপভোগ করি না, তা নয়। মজা পাই, আনন্দ পাই। মিডিয়ার কাছে কে না নিজেকে তুলে ধরে রাখতে চায়? এটা তো আমাদের কাজেরই অংশ। সেটা ভালো লাগে। কিন্তু সেটার জন্য আমি কনসার্নড নই। সেটার জন্য আমি নিজের ব্যক্তিগত জায়গাটাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চাই না। 

কিন্তু ব্যক্তি ইমনকে নিয়েও যখন প্রশ্ন আসে। বিতর্কের কথা বলছি না, ভালো প্রশ্নই যখন আসে। ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলোকে নিয়ে মানুষের আগ্রহ চরমে ওঠে। বারবার আলোচনা হয়। তখন সেটা নিয়ে কি সমস্যা তৈরি হয় কোনো?

ইমন: যত আলোচনা হয় ততই ভালো (হাসি)। তবে এখনও অবধি খুব খারাপ কিছুই আলোচনা হয়নি। আর কীই বা আলোচনা করবে? আমি গান নিয়েই থাকি। এখন যদি বর্তমানে ইমন কার সঙ্গে প্রেম করছে সেটা নিয়ে মানুষ আলোচনা করে, তবে করবে। সেটাকে আমি আটকাতে চাই না। যা ইচ্ছা করুক। 

‘বসতে দিও কাছে’-র ইমন কিংবা জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পরের ইমনের সঙ্গে আজকের ইমনের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসছে?

ইমন: আমার মনে হয় আমি একটু বড়ো হয়েছি। একটা সময় আমি যেভাবে প্রকাশ করতাম নিজেকে, নিজের ভেতরটা কেটে ফেলে বলে ফেলতে পারতাম, সেই জায়গাটা অনেকটাই গোছানো হয়েছে। এখন নিজেই নিজেকে গাইড করতে পারি। নিজেই নিজেকে গোছাতে পারি। এইটা একটা। নয়তো গানকে আমি আরও বেশি ভালোবাসতে শুরু করেছি। আরও বেশি বন্ধু করেছি। 

নতুন কোনো প্লেব্যাকের খবর পাব কি?

ইমন: হ্যাঁ। নিশ্চয়ই পাবে। একটি কাজ যেটি হয়েছে। সেটা আমি জানি না দেবে কিনা। অরিন্দমদার সিনেমা ‘মায়াকুমারী’-তে একটা গান আছে। আরও দু’তিনটে ছবিতে গান আছে। শিবুদাদের পরের ছবিতে গান আছে। আর একটা বড় ন্যাশনাল লেভেলের কাজ আসছে। যেটা আমি বিক্রমদার সঙ্গে করেছি। 

অরিন্দম শীল এবং বিক্রম ঘোষ দু’জনেই তো আপনার কেরিয়ার শুরুর দিনগুলোর সময় থেকেই জড়িয়ে ছিলেন?

ইমন: একদম। এখনও ওতপ্রোতভাবেই জড়িয়ে আছেন। এই দুটো নাম বললে ভুল হবে। সঙ্গে অনুপম রায় এবং শিবপ্রসাদ-নন্দিতা এঁরাও আমার জীবনে সাংঘাতিক রকমের জড়িয়ে আছেন।

জীবনের প্রথম প্লেব্যাকেই হয়তো কেউ জাতীয় পুরস্কার পান না!

ইমন: এটাও হয়তো সত্যি। (খানিকটা হেসেই)

আমার শেষ প্রশ্ন। এখন তো অ্যালবামের যুগ শেষ। লোকে সিঙ্গল নিয়েই আসে। কিন্তু আপনার যে এইভাবে পরপর পরপর অনেকগুলো সিঙ্গলস নিয়ে আসা, বিভিন্ন জঁরকে ধরতে চাওয়া, এর মাধ্যমে কি অলক্ষে অন্য কোনো অ্যালবামই বোনার চেষ্টা করলেন? এগুলোর পিছনে কি একটা পরিকল্পিত সুতো কাজ করেছে? নাকি একটা গান বেরিয়েছে তারপর বাকিগুলো নিয়ে ভাবনা-চিন্তা এসেছে?

ইমন: না। প্রহরই এই প্রশ্নটা আমার মাথায় ঢোকাল যে এইভাবেও ভাবা যায় (হাসি)!

Powered by Froala Editor

More From Author See More