সুড়ঙ্গপথে যাওয়া যেত রাজবাড়ি! শোভাবাজারের লাল মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে অদ্ভুত ইতিহাস

কথায় বলে, কলকাতা শহরের পথে পথে ইতিহাস। তবে সেই ইতিহাস ঠিক রাজপথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকলে অবাক লাগে বৈকি! ঠিক সেরকমই অবাক করা একটি মন্দির দাঁড়িয়ে চিত্তরঞ্জন অ্যাভেনিউর ঠিক মাঝখানে। শোভাবাজার মেট্রো স্টেশনের ঠিক সামনে এই মন্দিরটা সকলেরই চোখে পড়ে। অবাক লাগে নিশ্চই। লাল রঙের এই মন্দিরটিকে সকলে ‘লাল মন্দির’ বলেই ডাকেন।

কী এই লাল মন্দির? কবে থেকে শুরু এর ইতিহাস? এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই দ্বারস্থ হলাম মন্দিরের বর্তমান পুরোহিত নীলাম্বর ভট্টাচার্যের। “সে আজ অনেক বছর আগের কথা। অন্তত ২৫০ বছর আগে এখানে ছিল একটি মাটির ঘর। সেখানেই তন্ত্র সাধনা করতেন আমার পূর্বপুরুষ অমরকৃষ্ণ। আর তার পর থেকেই ক্রমশ মন্দিরে জনসমাগম হতে থাকে।” এই অমরকৃষ্ণ ঠাকুর শোভাবাজারের রাজাদের বাড়ি, অর্থাৎ নবকৃষ্ণ দেবের বাড়িতে চণ্ডীপাঠ করতেন। তবে অনেকের মতে নাকি স্বয়ং রাজবাড়ির উদ্যোগেই গড়ে উঠেছিল এই মন্দির।

নীলাম্বর ভট্টাচার্য বলছিলেন, “অনেকেই মনে করেন রাজবাড়ির মেয়েরা শক্তিপূজার জন্য এই মন্দির তৈরি করেন। দেববাড়ির আরাধ্য দেবতা কৃষ্ণ। তাই শাক্ত পুজোর জন্য মন্দির তৈরি হল বাড়ির বাইরে। আর এই মন্দির থেকেই নাকি সুড়ঙ্গপথে চলে যাওয়া যেত রাজবাড়ির অন্দরমহলে।” আবার এই মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রঘু ডাকাতের কাহিনিও। সেই দুর্ধর্ষ ডাকাত নাকি একসময় রাজবাড়ির সমস্ত সম্পত্তির সঙ্গে যোগমায়ার মূর্তিটিও লুঠ করে নিয়ে যান। তারপর একটি পুকুরে ফেলে দেন। রাজা নবকৃষ্ণ দেব স্বপ্নাদেশ পেয়ে আবার প্রতিমা তুলে এনে প্রতিষ্ঠা করেন।

এই মন্দিরকে ঘিরে আছে আরও নানা কাহিনি। রাস্তার ঠিক মাঝে এত বড়ো একটা মন্দিরের অবস্থান সত্যিই অবাক করে। ব্রিটিশ প্রশাসকরা রাস্তা তৈরির সময়েও সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। হোক রাজার মন্দির, কিন্তু রাস্তা তৈরির কাজ সবার আগে। তবে মন্দির ভাঙা হল না। শোনা যায়, অনেক মজুর নাকি তখন মন্দির ভাঙতে গিয়ে মুখে রক্ত উঠে মারা যায়। এরপর আরও নানা সময় রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য মন্দির ভাঙার প্রস্তাব ওঠে। কিন্তু প্রতিবারই প্রস্তাব বাতিল হয়।

মেট্রো রেলের কর্মকাণ্ডের সময়েও এই মন্দিরের গায়ে কোনো আঁচড় পড়েনি। মন্দির অক্ষত রেখে সুড়ঙ্গ খননের জন্য ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। আজও সেই মন্দিরের মধ্যে যোগমায়ার পাশাপাশি পুজো পাচ্ছেন গোপাল, শিব, অন্নপূর্ণা সহ আরও নানা দেবদেবী। সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত সহাবস্থান। মন্দির পরিচালনার জন্য আছে একটি ট্রাস্টিও। আর নিত্য পূজার পাশাপাশি প্রতি বৃহস্পতি ও শনিবার বিশেষ পূজার আয়োজন হয়। পথচলতি মানুষ হয়তো মাঝেমধ্যে উঁকি দেন, প্রণামীর পয়সা রেখে যান। কিন্তু তার ইতিহাসের খবর কজনই বা রাখেন?

আরও পড়ুন
তফসিলি উপজাতির মানুষ এবার মন্দিরের পুরোহিত, ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে নজির কেরালায়

Powered by Froala Editor

More From Author See More