হেমন্তের গানে রাগ ভুললেন পঙ্কজ মল্লিক, সজল হয়ে উঠল দুটি চোখ

তৃতীয় পর্ব

বাঙালির প্রাণপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’র বয়স তখন আট-নয়। আগেই বলেছি বাণীকুমারের কথায় এই জনপ্রিয় অনুষ্ঠানে ‘জাগো দুর্গা’ গানটি গাইতে শুরু করেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যখন গাইতে শুরু করেন তখন গানটির প্রথম লাইন ছিল ‘এসো তুমি দুর্গা দশপ্রহরণধারিণী’। পরবর্তীতে গানটি সামান্য পরিবর্তিত হয়। অবশ্য শুধু এই গানটি নয়, সেইসময় হেমন্ত কোরাস গানেও অংশ নিতেন। একটি কোরাস গান পরে বাদ যায়।

সে এক সোনালি দিন ছিল বাঙালির। বেতারের হাত ধরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সহ তাবড় তাবড় এক ঝাঁক নক্ষত্র নিয়ে মহালয়ার দিনে ভোর পাঁচটায় সরাসরি সম্প্রচারিত হত এই ঐতিহাসিক প্রভাতী অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’। তখন থেকেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এই অনুষ্ঠান, আজ প্রায় ৮৯ বছর পরেও যার জনপ্রিয়তা অম্লান রয়েছে। কত মানুষ নতুন রেডিও কিনে ফেলতেন তখন, শুধু মহালয়ার ঐ অনুষ্ঠানটি শুনবেন বলে। এই অনুষ্ঠান ছাড়া যেন দেবীপক্ষ শুরুই হবার  না। তখন সশরীরে হাজির থেকে অংশগ্রহণ করতে হত প্রোগ্রামে। কণ্ঠশিল্পী ও যন্ত্রসঙ্গীতশিল্পী সবাইকেই আগেভাগে উপস্থিত থাকতে হত। হেমন্তকে তৈরি থাকতে হত রাত্তির তিনটের সময়। সেদিন রাতে আর ঘুমতেন না তিনি, দেরি হয়ে যাবার ভয়ে। রেডিও অফিসের গাড়ি প্রথমে যেত পঙ্কজ মল্লিকের বাড়িতে, যাবার পথে তুলে নিত হেমন্ত ও অন্যান্যদের তাঁদের বাড়ি থেকে। বাড়ির সামনে গাড়ি এলে পঙ্কজবাবু গম্ভীর গলায় ডাকতেন ‘হেমন্ত’। নেমে আসতেন হেমন্ত। গাড়ি চলত রেডিও অফিসের দিকে। 

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ‘আনন্দধারা’তে লিখছেন, “বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ছিলেন এই মহালয়া প্রোগ্রামের প্রাণ। এটাকে উনি প্রোগ্রাম বলে মনে করতেন না। মনে করতেন যেন সত্যিই দেবীর বন্দনায় বসে গেছেন। রাত্তিরে গঙ্গাস্নান করে গরদের কাপড় পরে বসতেন বীরেনদা। কণ্ঠে তাঁর কত দরদ! বাণীকুমারের বাণী, পঙ্কজ মল্লিকের সুর, আর বীরেনদার দেবীবন্দনা। এরই ফাঁকে ফাঁকে আমাদের গান। কয়েকখানা গান গাইতাম আমি এই প্রোগ্রামে। বড় ভালো লাগত গাইতে।

প্রোগ্রামের পর সকলে মিলে বসে জিলিপি, সিঙাড়া খেতাম। একেবারে ঘরোয়া পরিবেশ। দিনগুলোকে আর ফিরে পাবো না কোনোদিন।…”

প্রকৃতঅর্থেই সেইসময় বহুশিল্পীর ‘দ্বিতীয় বাড়ি’ হয়ে উঠেছিল রেডিও অফিস। আজকের শিল্পীদের পক্ষে এসব ঘটনা কল্পনাতীত।

আরও পড়ুন
‘শত্রু এলে অস্ত্র হাতে লড়তে জানি’, ভারত-চিন যুদ্ধে গানই হাতিয়ার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের

এই অনুষ্ঠানের একটি ছোট্ট অভিজ্ঞতা হেমন্তবাবুর বন্ধু সমরেশ রায়ের কলমে : “পাকাপাকিভাবে মুম্বাইতে যাবার আগে, কলকাতা রেডিওতে ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ অনুষ্ঠানে হেমন্ত নিয়মিত অংশ নিত। আমরাও থাকতাম সমবেত সঙ্গীতে। আমরা যে গানখানি গাইতাম, পরে সেই কোরাস গানটি বাদ হয়ে যায়। …একবার সেই প্রোগ্রাম চলছে। লাইভ প্রোগ্রাম, সবাই আছি। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি হেমন্ত নেই। পঙ্কজদা, অর্থাৎ পঙ্কজকুমার মল্লিক, অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে, ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকাচ্ছেন। হঠাৎ স্টুডিওর কাচের জানলা দিয়ে দেখি, হেমন্ত বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। নিশ্চিন্ত ভঙ্গি, কারুর সঙ্গে কিছু একটা কথা বলছে। ঠিক সময়ে ভেতরে চলে এল। পঙ্কজদা চোখ দিয়েই ওকে ভস্ম করে দেন। কিন্তু কোথায় কী! প্রায় বসার সঙ্গে সঙ্গেই হেমন্ত গান ধরে দিয়েছে। পঙ্কজদা আস্তে আস্তে চোখ দুটি বন্ধ করলেন। মুখে একটা অদ্ভুত প্রশান্তি। হেমন্ত-র গান শেষ হল। পঙ্কজদা চোখ খুললেন। চোখ দুটি ইতিমধ্যে সজল হয়ে উঠেছে।…”

‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’র সূত্র ধরেই আরেকটি সাংঘাতিক ঘটনার কথা বলতে হয়। এই ঘটনাটি অবশ্য প্রায় তিন দশক পরের।

১৯৭৬ সালের জরুরি অবস্থার সময় কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কলকাতা বেতারে মহালয়ার দিন ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’র জায়গায় একই ধরণের নতুন একটি অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়। দেবীর আবাহনমূলক এই গীতিআলেখ্যটির নাম ছিল ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম্’ এবং এই অনুষ্ঠানটির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। লিখেছিলেন ডঃ ধ্যানেশনারায়ণ চক্রবর্তী, সঙ্গীত রচনা করেছিলেন শ্যামল গুপ্ত, সংস্কৃত শ্লোকপাঠে ছিলেন গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মাধুরী মুখোপাধ্যায়। এই অনুষ্ঠানে ছিল এক দুর্দান্ত চমক! ভাষ্যপাঠে ছিলেন স্বয়ং উত্তমকুমার! সঙ্গে ছিলেন বসন্ত চৌধুরী, পার্থ ঘোষ ও ছন্দা সেন। গানেও ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, মান্না দে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, উৎপলা সেন, অনুপ ঘোষাল, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শিপ্রা বসু, বনশ্রী সেনগুপ্ত, হৈমন্তী শুক্লা, অসীমা মুখোপাধ্যায়, পিন্টু ভট্টাচার্য, শৈলেন মুখোপাধ্যায়, সমরেশ রায়, জয়ন্তী সেন, অমল মুখোপাধ্যায় প্রমুখ একঝাঁক তারকা। যন্ত্রসঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন অলোকনাথ দে। যন্ত্রসঙ্গীতশিল্পীদের মধ্যে ছিলেন ভি বালসারা, অমর দত্ত, সুনীত চট্টোপাধ্যায়, রাধাকান্ত নন্দী, দূর্বাদল চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। এই অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারিত হয়েছিল ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৬ সালে মহালয়ার দিন ভোর চারটেয়। এই অনুষ্ঠান শুনে শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়া কি হয়েছিল তা নতুন করে বলবার নয়, প্রায় সবাই জানেন এবং অনেকেই হতো বাপ-ঠাকুরদার কাছে শুনে থাকবেন। এ বিষয়ে একটি ছোট্ট ঘটনার কথা উল্লেখ করি।

আরও পড়ুন
সরে গেলেন পঙ্কজ মল্লিক, ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র সঙ্গীত পরিচালনায় ২৪ বছরের যুবক হেমন্ত

যেদিন এই অনুষ্ঠানটি আকাশবাণীতে সম্প্রচারিত হয়, সেদিন সকালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বন্ধু সমরেশ রায় তর্পণ করতে গিয়ে গঙ্গার ঘাটে পা পিছলে পড়ে যান এবং কপালের কাছে বেশ খানিকটা কেটে যায়। তো ওষুধ লাগিয়ে সন্ধ্যাবেলা হেমন্তের বাড়ি গেছেন তিনি। স্বাভাবিকভাবেই ঘরভর্তি লোক সবাই সমরেশবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন যে কাটল কী করে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বলে উঠলেন, ‘আমাকে পায়নি তো হাতের কাছে, তাই লোকে ওর ওপরেই ঝাল ঝেড়েছে।’ এই রসবোধের মধ্যে দিয়েই টের পাওয়া যায়, অনুষ্ঠানটি শুনে শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়া ঠিক কিরূপ হয়েছিল।

আজ এত বছর পর ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম্’ শুনলে মনে হয় অনুষ্ঠানটি যে খুব খারাপ হয়েছিল এমন নয়, গানগুলি ছিল যথেষ্ট ভালো। কিন্তু কোথাও না কোথাও ভাষ্যপাঠ ও শ্লোকোচ্চারণে ছিল আন্তরিকতার অভাব। যে আবেগ নিয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র মাতৃবন্দনা করতেন, সেই আবেগ ছিল অনুপস্থিত। বাঙালি এই অনুষ্ঠান প্রত্যাখ্যান করে। শ্রোতাদের দাবি অনুযায়ী, এর পরের বছর পুনরায় মহালয়ার দিন কলকাতার বেতারে ফিরে আসে ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ এবং ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম্’ স্থানান্তরিত হয় মহাষষ্ঠীর ভোরে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইদানীং এটি প্রচার করার চেষ্টা চলছে যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় পঙ্কজকুমার মল্লিকের প্রতিপক্ষ হিসেবে এই অনুষ্ঠানটিতে নিজেকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এই ধারণা ভিত্তিপ্রস্তরহীন। পঙ্কজবাবুর প্রতি তিনি কতখানি সম্মান প্রদর্শন করতেন তার দৃষ্টান্ত খুব একটা কম নয়। প্রধানত কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বাধ্য হয়ে এবং খানিকটা নতুন কিছু করার পেশাদারি তাগিদে এই অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিচালনার ভার নিতে তিনি রাজি হয়েছিলেন। ‘হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও বেতার’-এর ইতিহাসে এ এক ঐতিহাসিক ঘটনা।

আরও পড়ুন
‘বিবিধ গানে’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যদি নিজেকে আরও একটু বেশি করে দিতেন!

এই বেতারের বিরুদ্ধেই এক সময় আবার সোচ্চার হয়েছিলেন হেমন্ত। ১৯৪৬ সালে আইপিটিএ থেকে সরে এসে শিল্পীদের যথাযথ সম্মান-দক্ষিণার দাবিতে গঠিত হল ‘আর্টিস্ট অ্যাসোসিয়েশন’, যুগ্ম-সম্পাদক হলেন জগন্ময় মিত্র ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। বহুদিন ধরে বঞ্চনার শিকার হয়ে তাবড় তাবড় শিল্পীরা যুক্ত হয়েছিলেন এখানে। মূল অভিযোগ ছিল বেতার সংস্থার প্রতি। সেইসময় অ্যাসোসিয়েশনের নির্দেশে বেতারে গান গাওয়া সাময়িকভাবে বন্ধ করেন তিনি এবং ঐ বছরের আগস্ট মাসেই বেতারকেন্দ্রের গার্স্টিন প্লেসের অফিসের সামনে পিকেটিং করেন শিল্পীরা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবার পর আবার বেতারে যোগদান করেন হেমন্ত।

বেতার চিরকালই ছিল সঙ্গীতশিল্পীদের বিভিন্ন ধারার সঙ্গীত পরিবেশনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থান। রেকর্ডের সাড়ে তিন মিনিটের সময়-বন্ধন না থাকায় এখানে বিভিন্ন ধরণের গানে স্বর্ণযুগের বিভিন্ন শিল্পীদের পরিবেশনের উৎকৃষ্টতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এবং সর্বোপরি, বেতারে বহুশিল্পীই বহু ঐতিহাসিক কাজ করেছেন, যা কোম্পানির রেকর্ডিং-এ আমরা পাই না। এদিক থেকেও হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও বেতারের রসায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এবারে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের এই অদ্বিতীয় রেকর্ডিংগুলি নিয়ে কিছু আলোচনা করা বিশেষ প্রয়োজন। 

Powered by Froala Editor

More From Author See More