কৃষিক্ষেত্রে বরাদ্দ বৃদ্ধিতে নারাজ অর্থ মন্ত্রক; ভালো ফলনের পরেও বঞ্চিত কৃষকরা

করোনার ধাক্কায় ক্রমাগত আরো বেসামাল হয়ে পড়ছে অর্থনীতি। চার দশকের মধ্যে প্রথমবার দেশের জিডিপি সংকুচিত হয়েছে ২৪ শতাংশ। যদিও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন কোভিডের মতো 'ভগবানের অভিশাপের' কারণে অর্থনীতির সংকোচন হলেও হতে পারে। যদিও করোনা সময় কালে বিশেষজ্ঞরা বারবারই আশঙ্কা করেছিলেন যে, জীবনের থেকেও বেশি সংশয় তৈরি হবে দেশের আর্থিক ব্যবস্থা নিয়ে। তবে সরকার জানিয়েছিল যে, এই দুর্বিপাকের মধ্যেও আশার আলো জ্বালিয়ে রেখেছিল কৃষিক্ষেত্র। এপ্রিল জুন মাসে যখন সব ক্ষেত্রে সংকোচন দেখা দিয়েছে, তখন গোটা বর্ষার মরশুমে ভালো বৃষ্টিপাত ও বীজ রোপণ করার ফলে কৃষি এবং তার সংলগ্ন ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার হয়েছে প্রায় ৩.৪ শতাংশ।

কিন্তু তার পরেও কৃষকদের পরিস্থিতির উন্নতি কি বিশেষ কিছু হয়েছে? পরিসংখ্যান বলছে, করোনা আবহের মধ্যেও গত বর্ষায় ধান, তৈলবীজ, তুলো ও অন্যান্য শস্য চাষ করা হয়েছে প্রায় ১১ কোটি হেক্টর জমিতে। এর ফলে ফলন নিয়ে যেমন দুশ্চিন্তার কিছু নেই তেমনই খাদ্যশস্যের দাম বাড়ার উপরেও নিয়ন্ত্রণ রাখা যাবে, সে কথা ঠিক। কিন্তু সঠিক দাম না পেলে কিন্তু আয় কমবে কৃষক ও কৃষি কাজের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য পেশার মানুষদের। সেটা হলে কৃষিক্ষেত্রে যে ‘ভিশিয়াস সাইকেল’ অথবা ‘দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র’ বহুচর্চিত, তার থেকে মুক্তির পথ কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। এছাড়াও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল উৎপাদিত খাদ্যশস্যের বাজার। দেশে উৎপাদিত খাদ্যশস্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ কিনে নেয় বিভিন্ন হোটেল বা রেস্তোরাঁ। কিন্তু কোভিড অতিমারীর জেরে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ এইসব স্থান। ফলে আগামী দিনে খাদ্যশস্যের বাজারে চাহিদা তৈরি না হলে অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মেই বিপুল ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কৃষকেরা।

এর মধ্যেই কৃষিক্ষেত্রকে চাঙ্গা রাখতে অর্থ দফতরের কাছে বেশকিছু স্কিমে বাজেট বৃদ্ধির আবেদন জানিয়েছিল কৃষি বিভাগ। কিন্তু কৃষি বিভাগের সেই আবেদন নামঞ্জুর হয়েছে অর্থ মন্ত্রকের কাছে। কৃষি বিভাগের কর্তাদের মতে, প্রধানমন্ত্রী ফসল বীমা যোজনা এবং প্রধানমন্ত্রী কৃষি সঞ্চয়ী যোজনার মতো স্কিমগুলিতে বাজেট বৃদ্ধি করলে লাভবান হত কৃষিক্ষেত্র। সেই সঙ্গেই আবেদন করা হয়েছিল কৃষি ঋণ মুকুব করা এবং শস্যদানার উপর ভর্তুকি দেওয়ার জন্য। কিন্তু খারিজ হয়ে গিয়েছে সেই আবেদনও।

সময়মতো কৃষকদের থেকে অর্থ ফেরত পাওয়া যায় না, এই যুক্তিতেই খারিজ করা হয়েছে কৃষি বিভাগের আর্থিক দাবি। বস্তুত কিছুদিন আগেই প্রকাশিত একটি রিপোর্টে দেখা গিয়েছে যে কৃষি সুরক্ষা খাতে প্রায় ৮০ শতাংশ কৃষকের থেকে পাওনা বাকি রয়ে গিয়েছে সরকারের। যেখানে সরকারের পাওয়া উচিত ছিল ৩৭৫০ কোটি টাকা, সেখানে কৃষকদের থেকে পাওয়া গিয়েছে কেবল ৭৭৫ কোটি টাকাই।

আরও পড়ুন
এক বছরে আত্মঘাতী ৪২ হাজার কৃষক ও মজুর, করোনা-পূর্ব পরিসংখ্যানেও স্বস্তি কই!

কিন্তু এই অনাদায়ী অর্থের পিছনে আসল কারণটা কী? প্রশ্নগুলো সহজ আর, উত্তরটাও জানা। ভারতীয় কৃষিক্ষেত্রের বরাবরের সমস্যা সেই আবহাওয়ার উপর নির্ভরশীলতা। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে ফসল নষ্ট হলে অথবা ফসলের জন্য উপযুক্ত দাম না পাওয়ার ফলে সরকারি ঋণ মেটাতে ব্যর্থ হচ্ছেন কৃষকরা। পরবর্তীতে একেই ঢাল করে ঋণ বৃদ্ধির প্রশ্নে বেঁকে বসেছে কেন্দ্র। কৃষি মন্ত্রকের এই বাজেট বৃদ্ধির দাবি বাতিল করার পিছনে একাধিক যুক্তি দেখিয়েছে অর্থমন্ত্রক। এর মধ্যে মূল দুটি কারণ হল, বরাদ্দ করা অর্থ ব্যয় করতে দেরি হওয়া এবং বাজেটের একটি বড় অংশ কৃষিক্ষেত্রে অব্যবহৃত থাকা। যদিও সরকারি নথি থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে ফসল বীমা প্রকল্পের জন্য যে বাজেট নির্ধারণ করা হয়েছিল তা যথেষ্ট তাড়াতাড়ি ব্যবহার হয়েছিল নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে। ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে প্রধানমন্ত্রী ফসল বীমা যোজনার আওতায় যে ১৪ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল, তারমধ্যে ৯ হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয় করা হয়েছিল প্রথম ছয় মাসের মধ্যে।

এর ভিত্তিতেই, কৃষি মন্ত্রক পরবর্তী অর্থবর্ষের বাজেট ১৪ হাজার কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ হাজার কোটি টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে সেই দাবিতে কান না দিয়ে বরং অর্থ মন্ত্রক সেটিকে আরও কমিয়ে ১৩,৬৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ করে কৃষিক্ষেত্রে। এর আগে ২৫ অক্টোবর, ২০১৮ তারিখে অর্থমন্ত্রকের কাছে দেওয়া চিঠিতে কৃষিমন্ত্রক জানিয়েছিল যে, এই প্রকল্পের বাজেট ২০২০-২১ অর্থবর্ষে ২৮ হাজার কোটি টাকা ও ২০১৯-২০ অর্থবর্ষের জন্য ২৪ হাজার কোটি টাকা হওয়া উচিৎ। সুতরাং পরিষ্কার যে, বাজেট বৃদ্ধির বদলে বরং কাটছাঁট করা হয়েছে তাতে।

আরও পড়ুন
বৃষ্টিতে মাঠ ভরেছে সবুজে, কৃষিকাজে ফিরে স্বস্তি পরিযায়ী শ্রমিকদের

এছাড়াও সরকারি নথি থেকেই এটা স্পষ্ট যে, কৃষকদের কৃষিঋণের উপর সুদে ছাড় দেওয়ার জন্য যে অর্থ বরাদ্দ হয়েছিল, তা কিন্তু বিফলে যায়নি। বরং সঠিকভাবেই ব্যয় করা হয়েছিল সেই অর্থ। সেই প্রেক্ষিতেই কৃষি মন্ত্রণালয় চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট এবং পরবর্তী অর্থবছরের জন্য সেই বাজেটের বৃদ্ধি চেয়েছিল। কিন্তু যথারীতি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে কৃষি মন্ত্রকের এই দাবিও।

অর্থাৎ যতই দেশের অর্থনীতির ভিত্তি হিসেবে কৃষিকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হোক না কেন, এখনও যে অর্থমন্ত্রক কৃষি ক্ষেত্রকে সেই দুয়োরানী করেই রেখে দিয়েছে তা বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয় না। কিন্তু দেশের অর্থনীতিতে কৃষি যে সত্যিই কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা কিন্তু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এই লকডাউন পরিস্থিতি। তাই কৃষিক্ষেত্র এবং কৃষকদের পরিস্থিতি নিয়ে আরও উদার ভাবে চিন্তা করা দরকার সরকারের। ভেবে দেখা উচিত ঠিক কোন যুক্তিতে কৃষিমন্ত্রক দাবি করে আসছে বাজেট বৃদ্ধির। যত বেশি নিজের পায়ে সবল হয়ে দাঁড়াবে কৃষি ক্ষেত্র, ততই কিন্তু শক্ত হবে দেশের মেরুদন্ডও— এটা যেন আমরা কিছুতেই ভুলে না যাই।

আরও পড়ুন
করোনা ও লকডাউনের আবহে, রাজ্যের কৃষিব্যবস্থার হাল ঠিক কেমন?

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Powered by Froala Editor

More From Author See More