বাটানগরে এলেন মারাদোনা, মফস্বলের মাঠে বুক ঠুকে চিৎকার – ‘ভামোস ভামোস...’

ভাষা বুঝতে পারছেন না এক বিন্দু। শুধু প্রবল উত্তেজনায় ডান হাত দিয়ে বারবার আঘাত করে চলেছেন বুকের বাঁদিকে। চিৎকার করে বলছেন, “ভামোস ভামোস।” বুকের বাঁদিক, অর্থাৎ যেখানে হৃদয়ের খুব কাছাকাছি। তিনি ফুটবলের রাজপুত্র যেন বলতে চাইছেন, “আমি ঠিক ওইখানটায় থাকি; ওই দিকটায়! তোমরা আমাকে ওখানেই রেখে দিও, হৃদয়ের কাছাকাছি...”

এভাবেই একটা মুখচোরা মফস্বল পেয়েছিল ফুটবলের রাজপুত্রকে। ২০০৮ সাল। প্রাক-স্মার্টফোন যুগে বাটানগরের মাঠের ধারে কাতারে কাতারে লোক অপেক্ষা করছে, কখন পৌঁছবে রাজপুত্রের পক্ষীরাজ ঘোড়া? অবশেষে ধুলো উড়িয়ে নামল হেলিকপ্টার। তার আগে এত প্রেস, এত মিডিয়া শেষ কবে দেখেছে এই ছোট্ট মফস্বলটা, খেয়াল পরছে না কারুরই। কাছাকাছি বাড়ি যাদের, তাদের অনেকেই আবার প্রবল উত্তেজনায় বারবার টিভি খুলে দেখে নিচ্ছে কেমন লাগছে তাদের মফস্বলটা টিভির পর্দায়। ছোট্ট একটা অনুষ্ঠান। তারপরেই রাজপুত্র চেপে বসলেন বাতানুকূল বাসে। বাতানুকূল এবং বুলেট প্রুফ। নীল আকাশি জার্সিকে ততদিনে প্রবল ভালবেসে ফেলা মফস্বল বালকের দু’হাত সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল বাস। তার দরজার কাচে সেঁটে পাগলের মতো ছটফট করছেন রাজপুত্র। যেন বলতে চাইছেন, আমাকে এত ঘেরাটোপে রাখা হচ্ছে কেন? কেন আমাকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না আমার ভক্তদের কাছে? বাস থেকে নেমেই সবুজ মাঠে দু’পায়ে উড়িয়ে দিচ্ছেন বল, আর মঞ্চে উঠলে বাঁ পায়ের ছাপ তুলে রাখার জন্য এগিয়ে দেওয়া হচ্ছে সিমেন্টের পাত।

সেই বাঁ পা, যার কথায় বিশেষণ হারিয়ে ফেলেছেন তাবৎ গ্রেটরা। “মারাদোনার বাঁ পায়ের থেকে বেশি সুখ কেউ ওই গোল বলটাকে দিতে পারেনি আর!” সতীর্থ ভালদানোর কথা ভোলা যায় নাকি? অথবা ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সেই বিস্ময় গোলের পর উবাচ গ্যারি লিনেকার, “আমার হাততালি দিতে ইচ্ছে হয়েছিল। বিশ্বাস করুন। এমন আগে কখনোই হয়নি... কিন্তু অমন একটা গোল দেখার পর... অবিশ্বাস্য; শিল্প!”

ঈশ্বরের বাঁ পা

 

অথচ নিজের উপর নিয়ন্ত্রণটাই হারিয়ে ফেললেন কেমন যেন! “খুব গরিব ছিলাম তো! ছোটবেলায় খেতে পারতাম না সেই ভাবে। তারপর খেলা শুরু হতে আরও হাজার রকম বাধা নিষেধ। তাই এখন খেলা ছাড়ার পর বেশি বেশি খেয়ে ফেলি। ওজনটা তাই নিয়ন্ত্রণে রাখা গেল না আর!” বলেছিলেন মারাদোনা। আর চোখের সামনে ঘটতে দেখছি একটা অবিশ্বাস। মারাদোনা সত্যিই কি? ওই ওখানে? অদ্ভুত সারল্যে বলে যাওয়া একের পর এক কথা। কথাগুলো অ্যামপ্লিফায়ার দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে দোভাষীর মাধ্যমে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে আশ্চর্য হয়ে বলে উঠছেন, “আপনাদের নেতা নাকি ফিদেলের বন্ধু ছিলেন? ফিদেল তো আমারও খুব ভালো বন্ধু!” ফুটবলের মাঝমাঠের সরলরেখার মত মিলিয়ে দিচ্ছেন তিনি জ্যোতি বসু থেকে ফিদেল কাস্ত্রো। তিনি পারেন। তিনিই পারেন। যেভাবে ঈশ্বরের হাতকে নিজের ক্ষমতায় নামিয়ে আনেন কাঁধের উপর, যেভাবে একেকটা ডজে কেটে যায় ছয়, সাত... আরও কত জন? যেভাবে অপ্রতিরোধ্য জার্মানদের সামনে নিজেই হয়ে ওঠেন একটা পাঁচ ফুটের বুলেট, সমস্ত লিগ্যাসি ভুলে অখ্যাত নাপোলি দলের জার্সি গায়ে পরে নিয়ে একা কাঁধে বইতে পারেন কে আর? সেই তিনিই তো!


কী ভীষণ দ্বৈতে ভরা একটা জীবন! ড্রাগের বিরুদ্ধে সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে অংশ নিয়েছিলেন প্রীতি ম্যাচে। অথচ ট্র্যাজেডি এমনই, বারবার জড়িয়ে পড়েছেন সেই ড্রাগের ফাঁদে। যদিও আবেগ দিয়ে বারবারই নিজের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ ভুলিয়ে দিতে পেরেছেন তিনি। জাতীয় দলের কোচ হয়েছেন। সাফল্য আসেনি। কিন্তু গোটা ফুটবল দুনিয়া দেখেছে কতটা আবেগ দিয়ে সাইড লাইনের ধারে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে পারে কোনও মানুষ। মিথের মতো একটা জীবন। আর্জেন্টিনার অন্ধকার গলি থেকে উঠে এসে রাজপ্রাসাদের সবথেকে ঝলমলে অন্দরমহলটা বরাদ্দ হয়েছিল যার জন্য। কে ভুলতে পারে সেই ছবি, যখন কলকাতায় এসে একটি কিশোরের হাত থেকে তিনি উপহার পেলেন চে গুয়েভারার ছবি, আর আবেগ রাখতে না পেরে অনামী কিশোরকে জড়িয়ে ধরলেন নিজের বুকে! পরেরদিন সংবাদপত্রের হেডলাইন হল, ‘দিয়েগো মারাদোনা কেম, স অ্যান্ড কনকার্ড আ সিটি’। নিজের জনপ্রিয়তা সম্বন্ধে কতটা কম ধারণা থাকলে একজন মানুষ লক্ষ লক্ষ মানুষকে নিজের সামনে দেখে বলে ফেলতে পারেন, “আমার দেশ থেকে কতদূর এই ভারতবর্ষ! অথচ এখানেও লক্ষ লক্ষ মানুষ আমাকে ভালোবাসেন দেখে আশ্চর্য হচ্ছি আমি! খুব ভালবাসি আপনাদেরকে। কলকাতাকে ভুলতে পারব না।”

আরও পড়ুন
ফিদেল কাস্ত্রো-র সংস্পর্শে নবজন্ম মারাদোনার; মৃত্যুতেও ছুঁয়ে রইলেন ‘দ্বিতীয় পিতা’কেই

ছবি ঋণ - ফেসবুক

 

যে ফুটবল স্টেডিয়াম উদ্বোধনের জন্য সুদূর আর্জেন্টিনা থেকে কলকাতা হয়ে এই মফস্বলে পা দিয়েছিলেন মারাদোনা, আজ ১২ বছর পেরিয়ে গেলেও একটা ইটও গাঁথা হয়নি সেখানে। কিছুদিন আগে হইচই পড়ে গিয়েছিল, মারাদোনার পায়ের ছাপ নেওয়া সেই সিমেন্টের ফলকটিও নাকি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে একদমই। এমনকি মারাদোনাকে নিয়ে আসতে যে বিপুল পরিমাণ খরচ করেছিল তৎকালীন রাজ্য সরকার, সেই অভিযোগের কাঁটাও বিঁধেছিল বড়ো তীক্ষ্ণ হয়ে। ‘লাল গড়’ হিসেবে পরিচিত এলাকায় ফাটল ধরেছিল তারপরেই।

কিন্তু এসবের অনেক ঊর্ধ্বে সেই বিস্ময় আবেগ আর টলটলে জল ধরা দুটো চোখ আজীবন মনে করে যাবে বাসের দরজায় দরজার উল্টো দিকে আটকে থাকায় একটা লোককে, যে ডান হাত দিয়ে ঘুঁষি মারছে বুকের বাঁদিকে; আর জানান দিচ্ছে, আমাকে ওখান থেকে ওখানে রেখে দেবে তো?

আরও পড়ুন
প্রয়াত ফুটবলের রাজপুত্র দিয়েগো মারাদোনা

দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনাকে বুকের বাঁ দিকের সেই ঘর থেকে বের করে, এমন সাধ্য কারুর আছে কি?

Powered by Froala Editor

More From Author See More