গল্পের প্লটের জন্য বন্ধুকে খুন করেছিলেন ‘শার্লক-স্রষ্টা’ কোনান ডয়েল?

পর্যবেক্ষণ কিংবা বিশ্লেষণে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। অপরাধি শানাক্তকরণে অনুমানবিদ্যার জনকও তিনিই। শার্লক হোমস। ২২১বি বেকার স্ট্রিটের বাড়িতে বসে যিনি সমাধান করেছেন একের পর এক দুর্ভেদ্য রহস্যের। যাঁকে ‘গুরু’ বলে সম্বোধন করতেন বাংলার আরেক কিংবদন্তি ডিটেক্টিভ ফেলু মিত্তির। এমনকি শার্লকের তদন্ত করার পদ্ধতিই পরবর্তীকালে একাধিক দেশের গোয়েন্দা বিভাগের হাতিয়ার হয়ে ওঠার বিরল নিদর্শনও রয়েছে। শার্লকের এই দূরদর্শিতার পিছনেই লুকিয়ে আছেন স্যার আর্থার কোনান ডয়েল। অপরাধের জাল বিন্যাস থেকে শুরু করে তার সমাধান— সবটাই তো আসলে তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত। ফলত, যেকোনো অপরাধের প্লটকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলতেও, তাঁর মতো দ্বিতীয় ব্যক্তি খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে সত্যিই কি কোনান ডয়েলের সঙ্গে যোগ ছিল অপরাধজগতের?

২০০০ সালের একেবারে শুরু দিক সেটা। স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর অভিযোগ তুলেছিলেন ব্রিটিশ মনোবিদ রজার গ্যারিক স্টিল। শুধু চুরিই নয়, একই সঙ্গে খুনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন আর্থার কোনান ডয়েল, এমনটাই দাবি রজারের। না, তাঁর এই দাবি একাবারেই মনগড়া নয়। একাধিক চিঠি, উইল, ডেথ সার্টিফিকেট পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে জোর কণ্ঠেই এই অভিযোগ তুলেছিলেন তিনি। কিন্তু কাকে খুন করেছিলেন আর্থার? আর এই খুনে কারণই বা কী?

‘দ্য হাউন্ড অফ দ্য বাস্কারভিলস’। ১৯০২ সালে কোনান ডয়েলের প্রকাশিত এই উপন্যাস যে তাঁর ব্যক্তিগত পছন্দের তালিকায় শীর্ষে ছিল, তা একাধিকবার জানিয়েছেন স্বয়ং শার্লকস্রষ্টা। আর এই উপন্যাসের জন্যই নাকি তিনি খুন করেছিলেন ব্রিটিশ সাংবাদিক ও বন্ধুস্থানীয় লেখক বারট্রাম ফ্লেচার রবিনসনকে। রজারের অভিমত আদতে ‘দ্য হাউন্ড অফ দ্য বাস্কারভিলস’-এর স্রষ্টা হলেন রবিনসনই। তাঁর থেকে এই গল্প চুরি করেন আর্থার। এবং পরবর্তীতে তিনি যাতে আসল ঘটনা প্রকাশ্যে না আনতে পারেন, সেজন্য বিষ খাইয়ে খুনও করা হয় তাঁকে।

বারট্রাম ফ্লেচার রবিনসন 

 

আরও পড়ুন
কোনান ডয়েলের চেয়েও বেশি শার্লক-কাহিনি লিখতে চান এই মার্কিন লেখিকা!

কিন্তু কতটা সত্যি এই অভিযোগ? ১৯৮৯ সাল। প্রথমবারের জন্য আর্থারের একটি চিঠি দেখে সন্দেহ জাগে মনোবিদ রজার গ্যারিকের মনে। তারপরই গবেষণার ময়দানে নামেন তিনি। একে একে শুরু হয় তথ্য ও নথি সংগ্রহের কাজ। কী উঠে আসছে সেই গবেষণায়? রজার জানাচ্ছেন, ডর্টমুর শহরে প্রচলিত ছিল এক ভূতুড়ে কুকুরের বহু প্রাচীন কিংবদন্তি। আর সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই রহস্য উপন্যাসের প্লট বুনেছিলেন রবিনসন। পরে বন্ধু আর্থারকে সেই গল্প শোনান তিনি। শুধু তাই নয়, তারপর ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি গোটা ডর্টমুর শহরের বিভিন্ন অঞ্চল নিজের ঘোড়ার গাড়িতে করে ঘোরান আর্থারকে। পরবর্তীতে সেই গল্প পুরোটাই বেমালুম টুকে দেন আর্থার কোনান ডয়েল। 

আরও পড়ুন
ফেলুদার শহরে শার্লক হোমসের ঠেক; ঢুঁ মারতেন সুকুমার সেন, প্রেমেন্দ্র মিত্র, নীরেন্দ্রনাথ, সমরেশ বসুরা

নথির হিসাব বলছে, ১৯০১ সালের শুরুর দিকে একই সঙ্গে চারদিনের ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন দুই ব্রিটিশ লেখক। সেইসময়ই জন্ম নিয়েছিলেন অতিবিখ্যাত ‘হাউন্ড অফ বাস্কারভিলস’-এর পটভূমি। প্রাথমিকভাবে আর্থার এবং রবিনসন একই সঙ্গে এই গল্পের নির্মাণ করবেন— ঠইক হয়েছিল এমনটাই। কিন্তু ব্রিটেনের প্রথম সারির পত্রিকা ‘স্ট্র্যান্ড’-এ এই উপন্যাসের প্রথম কিস্তি প্রকাশের সময় দেখা যায় সেখানে শুধু নাম রয়েছে আর্থার কোনান ডয়েলের। অবশ্য সেখানে রবিনসনের অনুপ্রেরণার কথা স্বীকার করেছিলেন শার্লকস্রষ্টা। এমনকি রবিনসনের কোচোয়ান এবং মালির নামও হুবহু তিনি ব্যবহার করেছিলেন গল্পে। কিন্তু তাই যদি হয়, তবে তো সম্পূর্ণ ভুয়ো হয়ে দাঁড়ায় রজারের অভিযোগ! 

আরও পড়ুন
মহামারীতে মৃত প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা করানোর টোপ, জড়াল শার্লক হোমসের স্রষ্টার নামও

আর্থার কোনান ডয়েল 

 

এই জায়গায় দাঁড়িয়ে রজার তুলে আনছেন আরও এক নথি। বা বলা ভালো এক সাক্ষাৎকার। আর স্বয়ং রবিনসনের কোচোয়ানের। রবিনসনের মৃত্যুর ঠিক পর পরই নেওয়া এই সাক্ষাৎকারে তাঁর গলাতেও ফুটে উঠেছিল সন্দেহের সুর। স্পষ্টতই তিনি জানিয়েছিলেন ডর্টমুর শহর ঘোরানোর সময় তিনি দুই বন্ধুকে চুক্তি করতে শুনেছিলেন এই গল্পের প্লট নিয়ে। রবিনসনের প্রস্তাব অনুযায়ী গল্পের নাম ঠিক হয়েছিল ‘অ্যান অ্যাডভেঞ্চার অফ ডর্টমুর’। এমনকি তাঁর নিজের হাতে লেখা গল্পের একটি কপিও উদ্ধার করা হয় পরবর্তীকালে। যার সঙ্গে হুবহু মিলে যায় ‘দ্য হাউন্ড অফ বাস্কারভিলস’!

তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, আর্থারের লেখা এই উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৯০২ সালে। আর রবিনসনের মৃত্যুর বছর কিন্তু ১৯০৭। তবে জীবদ্দশায় নিজে এমন অভিযোগ তুললেন না কেন রবিনসন? এই প্রশ্নের উত্তরে চুরি, খুনের সঙ্গে রজার মিশিয়ে দিয়েছেন পরকিয়ার তত্ত্ব। রবিনসনের স্ত্রী গ্ল্যাডিসের সঙ্গে নাকি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল আর্থারের। আর তাঁকে দিয়েই রবিনসনের ‘ব্রেন ওয়াশ’ করিয়েছিলেন আর্থার। সেই কারণে উপন্যাস প্রকাশের প্রথম কয়েক মাস রয়্যালটির একটা অংশ পেলেও পরে তা বন্ধ হয়ে যাওয়া নিয়ে আর কোনো উচ্চবাচ্য করেননি রবিনসন। পাশাপাশি গ্ল্যাডিসই হয়ে উঠেছিলেন তাঁর হত্যাকারী। দিনের পর দিন খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে তিনি হত্যা করেন রবিনসনকে। রজারের দাবি, আর্থার নিজে চিকিৎসক হওয়ায় টাইফয়েডকে রবিনসনের মৃত্যুর কারণ হিসাবে সাজিয়ে দিতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি!

বিশ শতকের শুরুতে এই রহস্যের বিষদ তদন্তের জন্য আহ্বান জানান ব্রিটিশ মনোবিদ রজার। আবেদন করেছিলেন যাতে সমাধিক্ষেত্র থেকে রবিনসনের দেহ তুলে পুনরায় পরীক্ষা করা হয়। অনুমতি দেয়নি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড। ফলত, সত্যি-মিথ্যার মাঝেই এই কিংবদন্তি রয়ে গেছে মিথ হয়ে। তবে রজারের দেওয়া তথ্য এবং বিস্তারিত গবেষণা শার্লকের হাড় হিম করা গল্পের প্লটের থেকে কোনো অংশেই কম নয়। শুধু রবিনসনই নন, পরবর্তীকালে একাধিক বিশেষজ্ঞও আর্থারের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তুলেছিলেন। এমনকি, কারোর মতে শার্লকস্রষ্টার হাতে রক্তের দাগ লাগাতে না চেয়েই তদন্ত করতে দিচ্ছে না স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড। তবে রজারের তত্ত্ব সত্যিই হোক কিংবা না হোক, একথা অস্বীকার করার জায়গা নেই রহস্যের জট তৈরি এবং তার সমাধানে আজও অদ্বিতীয় আর্থার কোনান ডয়েল…

Powered by Froala Editor

More From Author See More