লোককথা থেকে পূজার আসন, বাঙালির ‘ঘরের মেয়ে’ লক্ষ্মী বিরাজমান সর্বত্রই

লক্ষ্মীপুজো এমন এক পুজো, যে পুজোর জন্য পুরোহিতমশায়ের উপস্থিতি অনিবার্য নয়। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সেই অতি বিখ্যাত গানটির কথা মনে করা যাক। সেই গানে পূজার পদ্ধতি কীরকম? গানটি শুরু হচ্ছে এইভাবে, "শঙ্খ বাজিয়ে মাকে ঘরে এনেছি/ সুগন্ধী ধূপ জ্বেলে আসন পেতেছি/ প্রদীপ জ্বেলে নিলাম তোমায় বরণ করে/ আমার এ ঘরে থাকো আলো করে..." দেবীর আবাহন, স্থাপন, বরণ, উপাচার নিবেদন সবই কথক নারীটি নিজের মতোন ঘরোয়া পদ্ধতিতে করছে, দ্বিজ-পুরুষের মাধ্যম প্রয়োজন হচ্ছে না। দেবতার সঙ্গে ভক্তের যোগ এখানে একেবারে প্রত্যক্ষ। আলপনা এঁকে লক্ষ্মীর পট সাজানো, জলভরা ঘটে আমের পল্লব স্থাপন সবই সেই মেয়েটি করছে নিজে নিজে। খুব সহজ, মন ভালো করে দেওয়া সুরে সে গাইছে, "এসো মা লক্ষ্মী বসো ঘরে/ আমার এই ঘরে থাকো আলো করে..." 

বাংলার ঘরে ঘরে যে লক্ষ্মীর আসন পাতা, তিনি গজ-চতুষ্টয়ের দ্বারা অমৃতস্নানে প্রদীপ্তা কমলা নন, এমনকী শাস্ত্রীয় সংস্কৃত ধ্যানমন্ত্রের বর্ণনা অনুযায়ী চারটি হাতে পাশ, অক্ষমালা, সৃণি ও স্বর্ণকমলের ঐশ্বর্যও তো কই, তাঁর মধ্যে দেখা যায় না। তিনি যেন আমাদেরই ঘরের সুরূপা গৌরী মেয়েটি, লাল টুকটুকে শাড়ি আর শাঁখা-সিঁদুরে সেজে-গুজে, এক হাতে ঝাঁপিটি আগলে বসেছেন, অন্য হাতে অভয় দিচ্ছেন। পায়ের কাছে বসে আছে বাহনটি, দেবীর সাথে নামসাযুজ্যে তারও নাম হয়ে গেছে লক্ষ্মীপ্যাঁচা। যে ঠাকুরাণী বাংলার নারীসমাজের এত কাছের, তাঁর রূপ, তাঁর ধরনধারণ যেন অনেকখানিই মানবীর মতো।

লক্ষ্মীকে বাঙালি কি কেবল সুদূর দিব্যলোকের এক দেবীরূপেই দেখেছে? উঁহু। যে মেয়ের উপস্থিতিতে গৃহস্থালিতে সুখ-সমৃদ্ধি উছলে পড়ে, শান্তিকল্যাণে ভরে ওঠে ঘর, তাকেই সে বলেছে 'লক্ষ্মী মেয়ে', তেমন বধূকেই সে বলেছে 'সাক্ষাত লক্ষ্মী'। অল্প-চেনা মেয়েকে সসম্ভ্রমে ডাকতে হলে সে ডেকেছে ‘মা লক্ষ্মী’ বলে (রাজশেখর বসুর 'রাতারাতি' গল্পে উল্লেখ পাবেন); মেয়েদের ব্রতকথা শেখানোর বই লেখার সময়ে দক্ষিণারঞ্জন প্রত্যেকবার তাদের সম্বোধন করে বলেছেন ‘লক্ষ্মীরা’! শুধু কি মেয়েরা? তেমন শ্রী, তেমন শান্তি কোনও পুরুষমানুষে খুঁজে পেলে, বাঙালি তাকেও বলেছে 'লক্ষ্মীমন্ত'। 

লক্ষ্মীর বরপুত্র শ্রীবৎস রাজার (নামেই তাঁর স্ব-ভাব প্রকাশিত) গল্প বাংলার এক অতি জনপ্রিয় লোককথা। লালবিহারী দে'র সংকলিত 'Folk Tales of Bengal' বইতে এ গল্পটি আছে, লীলা মজুমদার অনূদিত বাংলা সংস্করণে তার নাম 'শনির দৃষ্টি'। গল্পটি এরকম- লক্ষ্মী আর শনির মধ্যে কে বড়ো, তাই নিয়ে দুজনায় দারুণ ঝগড়া বেঁধেছে স্বর্গলোকে। ফয়সালা করতে দুজনে মর্ত্যলোকের রাজা শ্রীবৎসের দ্বারস্থ হলেন। রাজা মনে মনে অনেক ভেবে, লক্ষ্মীকে বসতে দিলেন সোনার আসনে, শনিকে দিলেন রূপোর আসন। রাজার নীরব বক্তব্যটি বুঝে নিয়ে লক্ষ্মী প্রসন্ন হলেন, আর ক্রুদ্ধ শনি বারো বছর কুদৃষ্টি দেবার সঙ্কল্প করলেন। সেই বারো বছর ধরে নানা দুর্ভোগ পোহালেন রাজ্যহারা শ্রীবৎস, স্ত্রী চিন্তামণির সঙ্গেও তাঁর বিচ্ছেদ ঘটে গেল একসময়। কিন্তু দুজনের কেউই হাল ছাড়লেন না, লক্ষ্মীর চরণ ভরসা করে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে গেলেন। শেষে আবার তাঁদের পুনর্মিলন ঘটল, রাজা রানি ফিরে এলেন তাঁদের হারানো প্রতিষ্ঠা। শনি এসে আশীর্বাদ করে গেলেন, লক্ষ্মীর জয় হল। 

কাশীরাম দাসের অনূদিত মহাভারতের বনপর্বেও এ গল্পের আরেকটি সংস্করণ রয়েছে। সেখানে বনবাস-পীড়িত রাজা যুধিষ্ঠিরকে ভরসা জোগানোর জন্য তাঁরই মতো ভাগ্যহত, কিন্তু হার-না মানা শ্রীবৎস রাজার কাহিনি শুনিয়েছেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। গল্পের প্লটে একটু আধটু অদল-বদল তো থাকবেই, তবে এই সংস্করণের সবচেয়ে বড়ো বিশিষ্টতা হল, এখানে কাহিনীর নায়িকা চিন্তামণি স্বয়ং লক্ষ্মীর অংশজাতা - "চিন্তাদেবী তাঁর ভার্যা লক্ষ্মী অংশে জন্ম"। শ্রীবৎসের জীবনে দেবী লক্ষ্মীর মহিমার প্রত্যক্ষ প্রকাশ তাঁর জীবনসঙ্গিনী! 

বাঙালির লক্ষ্মী-আখ্যানের আরেকটি অতি লোকপ্রিয় নিদর্শন হল ‘লক্ষ্মীর পাঁচালী’ বা লক্ষ্মীদেবীর বৃহস্পতিবারের ব্রতকথা। একটানা পয়ার ছন্দে সরল ভাষায় লিখে যাওয়া এই আখ্যানের রচয়িতার নাম অজ্ঞাত, রচনাকালও মেলে না। স্থানভেদে, কালভেদে, বিভিন্ন সংস্করণে এই আখ্যান মূল কাঠামোটি এক রেখে একটু একটু বদলে বদলে যায়। এই লক্ষ্মী-কাব্যের আদি কবি কে, তা জানা না গেলেও রচনাকাল নিয়ে একটু আন্দাজ করা যেতে পারে। কাহিনির শুরুতেই মর্ত্যলোকে যে প্রবল দুর্ভিক্ষ, অন্নাভাব ও হতাশার ছবি, তা সম্ভবত বঙ্গদেশে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রথম আঘাত 'ছিয়াত্তরের মন্বন্তর' (১১৭৬ বঙ্গাব্দ, অথবা ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দ)-এর সামূহিক স্মৃতির কাব্যরূপ। এই পাঁচালি সভা করে বসে কথকঠাকুরের মুখে শোনার প্রথা নেই। ঘরোয়া পরিবেশে বৃ্হস্পতিবার মেয়েদের সন্ধ্যাকালীন লক্ষ্মীপুজোর অঙ্গ এই পাঁচালি পাঠ। সুতরাং অনুমান করা যায়, বিদ্যাসাগরের স্ত্রীশিক্ষা-বিপ্লব যখন বাংলা জুড়ে বেশ প্রচার-প্রসার পেয়েছে, এ রাজ্যের ঘরে ঘরে যখন মেয়েদের সাক্ষরতা ও টুকটাক পড়াশোনা করার চল বেশ ভালোমতন মজবুত হয়েছে, তখনই সাপ্তাহিক নারীপাঠ্য এই লক্ষ্মী-মাহাত্ম্য কাব্যের প্রচার ও প্রসার - যার জনপ্রিয়তা এখনও অমলিন! 

আরও পড়ুন
মহানায়কের বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো; ৭০ বছর ধরে একই পরিবারের হাতে তৈরি প্রতিমা

কিছুদিন আগে, বিশিষ্ট  কবি ও বুদ্ধিজীবী যশোধরা রায়চৌধুরী এই কাব্যের বিশেষ কিছু সংস্করণের কয়েকটি খণ্ডকে নারীবিরোধী, অতি-রক্ষণশীল পুরুষতান্ত্রিকতার চিহ্নরূপে গণ্য করেছেন। এবং তাঁর আগ্রহে, কয়েকজন হালফিলের কবি নতুন করে লিখেছেন লক্ষ্মীর পাঁচালী - যেখানে উঠে এসেছে কন্যাভ্রূণ হত্যা, নারীর অবৈতনিক গৃহশ্রম কিংবা দক্ষিণ ভারতের মন্দিরে মেয়েদের প্রবেশ নিষিদ্ধ রাখার প্রথা - এইসব সাম্প্রতিক নারীবাদী আন্দোলনের বিভিন্ন ইস্যু। চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, অনুরাধা কুন্ডা, মঞ্জিস রায় প্রমুখ এই নতুন পাঁচালির কারিগর। সোশ্যাল মিডিয়ায় তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করার পর,  এই নতুন কবিতাগুলি 'লক্ষ্মীর পাঁচা৯' সংকলনে এক মলাটে বদ্ধ হয়ে প্রকাশ পেয়েছে। 

কী পুরনো, কী নতুন, বাঙালির সমস্ত লক্ষ্মী-মাহাত্ম্য আখ্যানেই আমরা পেয়েছি ভেঙে-ছড়িয়ে যাওয়া, লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া দুর্দশা থেকে আলোর পথে যাত্রার গল্প, দুর্ভাগ্যকে পাত্তা না দিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে লড়ে যাওয়ার গল্প, জীবনের গল্প। মানুষের অন্তরে নিহিত এই অপরাজেয় শক্তিরই মূর্তিমতী প্রকাশ হলেন আমাদের লক্ষ্মীঠাকরুন, সেই শক্তির জাগরণেই আমাদের লক্ষ্মীলাভ।

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
মুঠপুজো - গ্রামবাংলার যে আদিম লক্ষ্মী-আরাধনায় শুরু হয় নবান্নের মাস