বই কেন ঝাড়ে

বইমেলা থেকে ফিরে || পর্ব— ৪

বন্ধু পৃথ্বীর সঙ্গে আড্ডায় উঠে এসেছিল এক মজাদার পরিকল্পনা, বইচুরি নিয়ে একটি সংখ্যা করব আমরা। কেবল বইমেলাই নয়, কলেজ স্ট্রিট থেকে পুরোনো বইয়ের বাজার অব্দি যে সমস্তটাতেই ছড়িয়ে রয়েছে বইচোররা তা আমরা সকলেই জানি। আমাদের মধ্যেই তারা উঠছে, বসছে, চা খাচ্ছে, স্টলে ঢুকছে আর সুযোগ মতো কখন বই তুলে নিচ্ছে বিনামূল্যে তা আমরা জানতেও পারছি না। পৃথ্বী চটজলদি একটি নামও ভেবে দেয় এই সংখ্যার, ‘বই কেন ঝাড়ে…’

আমাদের সে কাজ স্থগিত থাকলেও চারপাশের বই চোরেরা কেউ থেমে নেই, একদম গোড়াতেই যদি ভাবি তাহলে এই গোষ্ঠীকে মূলত তিনভাগে ভাগ করা যায়, প্রথম আসে, যারা ঝাড়ে এবং প্রচণ্ড নেশায় তা ফেসবুকে জানিয়ে দেয় পাবলিশারকে ট্যাগ করে, দ্বিতীয়ত যারা প্রতিষ্ঠান পছন্দ করে না বলে কেবল প্রাতিষ্ঠানিক স্টলে লাইন দিয়ে ঢোকে এবং বই ঝাড়ে, তৃতীয়ত আমাদের সেইসব বন্ধু যারা ভালো লেখে অথচ বন্ধুর টেবিল সামলাতে এসে তার ব্যাগ থেকেই ঝেপে দেয় কিনে রাখা বইয়ের প্যাকেট। তৃতীয়জনদের কাছে প্রতিষ্ঠান কোনও বিষয় নয়, তারা ছোটো পত্রিকাকেও সেই একই উচ্চতায় রাখে।

বইচুরিকে নানা সময়ে নানাভাবে দেখেছেন প্রকাশকরা, তাঁরা জানেন এ এক এমন জিনিস, যা হয়তো আটকানো যাবে না অথবা উচিত হবে না। এই নিয়ে তাঁরা কেউ পত্রিকায় রম্যরচনা লিখেছেন তো কেউ লাইভে এসে বলে গেছেন দুঃখের কথা। দুহাজার সাত সালের মেলায় মনে পড়ে এক পরিচিত প্রকাশক একটি তরুণ ছেলেকে ধরে ফেলেন বই চুরি করতে, ছেলেটি হাতেপায়ে ধরে ক্ষমা চায়। প্রকাশক তাকে পুলিশের হাতে না দিয়ে তাকে দিয়েই বিক্রি করিয়ে দেয় ওই বইয়ের কপিটি। ছেলেটিও খুশি খুশি ঘুরতে থাকে বাকি মেলা। 

আরও পড়ুন
হস্তাক্ষর

না বলে অন্যের জিনিস নেওয়া অপরাধ বলেই জেনে এসেছি আমরা, টেবিলের এপাশে থাকি বলে নয়, যতই তত্ত্ব ভেসে আসুক শিক্ষা মানুষের ফান্ডামেন্টাল রাইট, স্কুলের বই যখন পাড়ার দোকান থেকে কিনেই নিতে হয় তখন সাহিত্যও কেন প্রকাশকের ঘর থেকে কিনে পড়া নয়? বইয়ের দাম বাড়ছে, বাড়ছে পাতার দাম, ট্রান্সপোর্ট, ছাপাখানা, শ্রমিকের মজুরি, তেলের দামও। এখনও তিনশো কপির এডিশন থেকে একটি কপি আমি চুরি করা মানে বাঁধাই শিল্পীর ঘরের দু’টাকা, ভ্যানওলার আট-আনা আর ছাপাখানার দশটাকা না বলে তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া। 

আরও পড়ুন
দূরপাল্লা

স্পষ্টতই এই লেখার পর ক্ষুণ্ণ হবেন পরিচিত অনেকেই। তারপর হয়তো কোনো একদিন সংখ্যাটি করে উঠব আমি এবং পৃথ্বী, সেই সংখ্যাও হয়তো চুরি হবে কয়েক কপি আমার টেবিল থেকে। তবু যারা গাড়ি নিয়ে মেলায় এসে হাজার হাজার টাকার বই ঝাপে, কেবল আনন্দেই, তারা কি জানেন না নুড়ি-পাথর দিয়েও ঘর সাজানো যায়? বিনামূল্যে। 

আরও পড়ুন
একান্নবর্তী

এবছর বইমেলা অসময়ে, মাটি ফাটানো রোদ্দুরে চোখ কুঁচকে বসে আছেন বিক্রেতারা, গায়ের পোশাক থেকে সরে গেছে সোয়েটার, জ্যাকেট, চাদর। এবছর বইমেলায় বইচুরির রিপোর্টও খানিক কম বলেই শুনছি আমরা। গ্রীষ্মের এই এক মাধুর্য, (চাদরে বই লুকিয়ে)আসছি বলে স্বচ্ছন্দে চলে যাওয়া যায় না…

Powered by Froala Editor