চৈতন্যদেব নাম দিয়েছিলেন ‘নব-নীলাচল’, বাংলার প্রাচীনতম রথযাত্রার সঙ্গে জড়িয়ে শ্রীরামপুর

কথায় আছে, ভক্তের জন্যেই ভগবান। তাঁর সার্থকতা তো ভক্তের ভক্তিতেই। আর তাই জগন্নাথ দেবকে ভোগ খাওয়ানোর আশায় যখন  ব্রহ্মচারী ধ্রুবানন্দ পুরীর মন্দিরে যান, সেবয়েতরা তাঁকে ফিরিয়ে দিলেও, ভক্তের মনোবাঞ্ছা ফিরিয়ে দেননি জগন্নাথদেব। ধ্রুবানন্দ স্বপ্নাদেশ পেলেন বাংলায় ফিরে এসে জগন্নাথ দেবের মন্দির স্থাপনের। হুগলি নদীর ধারে মাহেশ (বর্তমানে যা হুগলি জেলার শ্রীরামপুর শহরের অন্তর্গত) নামে এক জায়গায় স্থাপন করলেন ইতিহাস প্রসিদ্ধ ‘মাহেশের মন্দির’। বাংলার প্রথম রথযাত্রার শুরু এখানেই।

ভাগীরথী নদীতে ভেসে আসা নিম কাঠ থেকে নির্মিত হয়েছিল মাহেশের জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা মূর্তি। ইতিহাস বলে, সন্ন্যাস গ্রহণের পর একবার নবদ্বীপ থেকে পুরী যাওয়ার পথে মহাপ্রভু চৈতন্যদেব এই মাহেশের মন্দিরে আসেন। পুরীর মন্দির প্রসঙ্গে কথিত ছিল ‘নীলাচল’ নামটি। মাহেশের মন্দির দেখে মুগ্ধ মহাপ্রভু এই মন্দিরের নাম দেন ‘নব নীলাচল’।

ধ্রুবানন্দের প্রতিষ্ঠিত সেই পুরনো বিগ্রহ আজও পূজিত হলেও, রথের ইতিহাস খানিক পালা বদলের কথাই বলে। মাহেশের প্রথম রথটি নির্মাণ করেন এক মিষ্টি ব্যবসায়ী ১৭৫৪ সালে। জানা যায়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হুগলি জেলার তৎকালীন দেওয়ান শ্যামবাজারের কৃষ্ণরাম বসু রথযাত্রায় এসেছিলেন। পরের বছর তিনি পাঁচটি চূড়া বিশিষ্ট কাঠের নতুন রথ নির্মাণ করেন, আর দায়ভার নেন মাহেশের রথের। রথ চলাচলের জন্য তৈরি করে দেন চওড়া রাস্তা। পরবর্তীকালে ১৭৯৮ সালে জীর্ণ রথের পরিবর্তে তাঁর ছেলে গুরুপ্রসাদ নয় চূড়ার নতুন রথ নির্মাণ করে দেন। সেই থেকেই এই বসু পরিবারের দায়িত্বে মাহেশের রথ। সেই রথও পুড়ে যায় ১৮৮৪ সালে, রথযাত্রার দিন। বসু পরিবারের তৎকালীন কর্তা কৃষ্ণচন্দ্রের তত্ত্বাবধানে মার্টিন বার্ন কোম্পানি দ্বারা পরের বছর তৈরি হয় বর্তমানের এই ১২৫ টন ওজনের লোহার রথটি। ৫০ ফুট উচ্চতার চারতলা এই রথটির নির্মাণে খরচ পড়েছিল ২০ লক্ষ টাকা। রথের এক-একটি তলা আলাদা আলাদা পুরাণকথা বলে। কৃষ্ণলীলা, চৈতন্যলীলা, রাসলীলার ছবি আঁকা আছে রথের দেওয়ালে। এছাড়াও রথে রয়েছে তামার ঘোড়া এবং কাঠের সারথি।

স্নানযাত্রার দিন দু'মণ দুধ আর ২৮ ঘড়া জলে স্নান করার পর ধুম জ্বর আসে জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার। জ্বর সারাতে ডাক পড়ে গোঘাট, আরামবাগ আর ঘাটালের তিন করিরাজের। তারপর কবিরাজের পাঁচনে আস্তে আস্তে জ্বর সারে তিন ভাই বোনের। রথযাত্রার আগের দিন মন্দিরের দরজা খোলে, সেইদিন ‘নবকলেবর’ উৎসব হয়। মাহেশের মন্দিরের প্রধান সেবায়েত সোমেন অধিকারী বলেন, পুরীর মন্দিরে যেভাবে নতুন কাঠ দিয়ে বিগ্রহ নির্মাণ করে এই উৎসব করা হয়, মাহেশে সেই প্রাচীন বিগ্রহের নতুন করে অভিষেক করে প্রতি বছর এই উৎসব করা হয়।

আরও পড়ুন
বন্ধ হবে না পুরীর রথযাত্রা, শর্তসাপেক্ষে অনুমতি সুপ্রিম কোর্টের

অবশেষে রথের দিন সুসজ্জিত রথে চেপে মাসির বাড়ির দিকে রওনা দেন জগন্নাথ। মাসি মানে জগন্নাথ দেবের পৌর্ণমাসি গুণ্ডিচা দেবী। প্রথমে চাতরায় মাসির বাড়ি ছিল বলে জানা যায়। পরবর্তীকালে পাথুরিয়াঘাটার মতিলাল মল্লিকের স্ত্রী রঙ্গমণি দেবী বর্তমান জি.টি. রোডের ধারের ‘মাসির বাড়ি’টি নির্মাণ করেন। অগণিত ভক্ত রথের রশিতে টান দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যায় রথ। কাঁসর, ঘণ্টা, বিউগল বাজে। প্রচলিত আছে, রথের দিন এই রশিতে টান দিলে নাকি পুণ্যলাভ হয়। তাই দূরদূরান্ত থেকে ভক্তের ঢল নামে এইদিন। জগন্নাথও দিব্যি রথে করে পৌঁছে যান তাঁর মাসির বাড়ি। টান শেষ হয় বন্দুকের গুলির শব্দে। এখানেই থাকেন ১৫ দিন। তারপর উল্টোরথের দিন ফিরে আসেন নিজের মন্দিরে।

আরও পড়ুন
মোঘল সম্রাটের পর করোনা; এবারের মতো স্থগিত পুরীর রথযাত্রা, নির্দেশ কোর্টের

এই রথকে কেন্দ্র করে প্রতিবছরই বসে বিশাল মেলা। মনোহারী থেকে খাবারের দোকান কিংবা ফুলের গাছ হরেক মালের মেলা। এছাড়াও থাকে নানারকমের রাইড, রাস্তার ধারে থাকে বিশাল নাগরদোলা। মাহেশের রথের মেলায় এসে জিলিপি আর পাঁপড় ভাজা না খেলে নাকি আগমন পূর্ণই হয় না। জি.টি রোডের ধারে বসে জিলিপি পাঁপড়ের দোকান। একমাস থাকে এই মেলা। কথিত আছে, শ্রীরামকৃষ্ণ নাকি এসেছিলেন এই মেলায়। যদিও শ্রীরামপুরের পুরনো বাসিন্দারা সকলেই বলেন, এই মেলার আড়ম্বর এখন আগের থেকে অনেক কমে গেছে। কিন্তু পুলিশকর্তারা বলবেন অন্য কথা। ভগবানের টান আর পুণ্যলাভ এই দুইয়ের চাপে ভিড় সামলাতে এখনো প্রতিবছর জেরবার হন তাঁরা।

আরও পড়ুন
করোনার জেরে ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত, এ-বছর পুরীর রথ বেরোবে না পথে

তাই অগত্যা ৬২৪ বছরের ইতিহাসে এবছর ছেদ আনতেই হল। আনলক পর্যায়ে দেশে নিষেধাজ্ঞা-বিধি খানিকটা শিথিল হলেও কোভিড সংক্রমণ মোকাবিলায় ভিড় এড়ানো এখনো বাধ্যতামূলক। আর তাই পুরীর পর এবার মাহেশের রথযাত্রাও স্থগিত রাখার সিদ্ধান্তের দিকেই এগোল ট্রাস্টি বোর্ড, শনিবার জেলা প্রশাসনের সাথে আলোচনা করে এমনটাই জানান সম্পাদক পিয়াল অধিকারী। এবছরের মতো মাসির বাড়ি যাওয়ার পরিকল্পনা ত্যাগ করলেন জগন্নাথ দেব। নিয়ম রক্ষার্থে শুধু নারায়ণ শিলাকেই মাসির বাড়ি পাঠানো হবে, একথাই জানান তিনি।

আরও পড়ুন
স্কেচবুকে এই শহরের ইতিহাস আর বুনবেন না রথীন মিত্র

এহেন মাহেশের রথের মেলায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘রাধারাণী’ এসেছিলেন বনফুলের মালা নিয়ে। অসুস্থ মায়ের পথ্য জোগাড় করতে জগন্নাথই ছিলেন তার শেষ আশ্রয়। সেইসব মালা বিক্রেতার দল আজ প্রায় গোটা দেশ থেকেই বিদায় নিয়েছেন। মাহেশের রথের মেলাতেও আজকাল নানা আধুনিক দ্রব্যের বাজার গড়ে ওঠে। কিন্তু করোনার আক্রমণে সেটাও বন্ধ থাকছে এ-বছর। একটা ধর্মীয় উৎসব শুধু নয়, বন্ধ হয়ে গেল অনেকগুলো মানুষের সারা বছরের উপার্জনের রাস্তাও। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অচলাবস্থার মধ্যে অবশ্য এো তো হওয়ারই ছিল...

Powered by Froala Editor