কবিতা থেকে সিনেমা - সর্বত্রই নতুন ভাষা খুঁজেছেন বুদ্ধদেব

একদল ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়ে একসঙ্গে খেলতে বসেছে। খেলার উপকরণ কী? না বাজারে সেসব কিনতে পাওয়া যায় না। জঙ্গলের ধারের ঘাস-পাতা থেকে সংগ্রহ করে আনা নানা রকমের পোকা। তাই নিয়েই চলছে শিশুদের অদ্ভুত খেলা। অথবা সেই বিখ্যাত বাঘ নাচানোর দৃশ্য। আমাদের অতি কাছের অথচ অচেনা সব দৃশ্যকে এক অদ্ভুত কায়দায় সিনেমার পর্দায় তুলে আনতে পারতেন যে মানুষটি, তাঁর নাম বুদ্ধদেব দাশুগুপ্ত।

শুধুই চলচ্চিত্র পরিচালক নন। পাশাপাশি লিখেছেন অসংখ্য কবিতাও। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, ভাস্কর চক্রবর্তীর হাত ধরে বাংলা সাহিত্যে গদ্য-কবিতার একটা নতুন যুগ শুরু হয়েছিল। তিনি আক্ষেপ করে বলতেন, তাঁর কবিতা পড়ে অনেকেই বলেছেন বুদ্ধদেব নতুন ধারার কবিতা লেখে বটে। কিন্তু যখন সিনেমা বানাতে শুরু করলেন, তখনই এসে পড়ল ঋত্বিক ঘটক বা সত্যজিৎ রায়ের তুলনা। যদিও নির্মাণশৈলী থেকে কাহিনি নির্মাণ, সবকিছুতেই তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র। অগ্রজদের প্রভাব যে পড়েনি তা নয়। কিন্তু বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত সবসময় চেয়েছেন, তাঁর সিনেমার ভাষা হবে সম্পূর্ণ নিজস্ব।

১৯৭৮ সালে ‘দূরত্ব’ ছবি দিয়ে পথচলা শুরু। তারপর একে একে তৈরি করে চললেন ‘বাঘ বাহাদুর’ (১৯৮৯), ‘তাহাদের কথা’ (১৯৯২), ‘চরাচর’ (১৯৯৩), ‘উত্তরা’ (২০০০)। তাঁর কবিতার মধ্যে চিত্রময়তা তো ছিলই। আর এবার সিনেমার মধ্যে ঢুকে পড়ল কাব্যময়তা। দর্শকদের অবাক করেছে তাঁর সিনেমার অদ্ভুত সব দৃশ্য। পরিচালক বলতেন, এইসব আসলে তাঁরই ছেলেবেলার স্মৃতি থেকে  সংগ্রহ করে আনা দৃশ্য।

১৯৪৪ সালে দক্ষিণ পুরুলিয়ার আনারা গ্রামে জন্ম। সেখানকার রেলের কোয়ার্টারে বাবা ছিলেন ডাক্তার। এরপর বাবার কাজের সূত্রে ঘুরতে হয়েছে নানা জায়গায়। খড়গপুর থেকে বিন্ধ্যপর্বতের মনীন্দ্রগড় পর্যন্ত দেখেছেন শৈশবের চোখ দিয়েই। লক্ষ করেছেন ভৌগলিক দূরত্ব কীভাবে মানুষের জীবন, ভাষা, সংস্কৃতির পার্থক্য ঘটিয়ে দেয়।

দেশভাগের পর তাঁর মামারা উঠে এসেছিলেন কলকাতার হাজরা রোডে। তখনও সেখানে গরুর গাড়ি চলত। সকালে ফিরিওয়ালার হাঁকে ঘুম ভাঙত মানুষের। পরে এইসব দৃশ্যই বারবার উঠে এসেছে তাঁর সিনেমায়। কবিতাতেও। 'গভীর আড়ালে', 'কফিন কিম্বা স্যুটকেস' সবই তো সেই দৃশ্যকল্পের রচনা। একটি কবিতায় তিনি লিখেছিলেন, "বুড়ো ঘোড়া জানলার পাট খুলে / ঘরের ভেতর উঁকি মারে, দ্যাখে / তার মাদী ঘোড়া কাদা হয়ে গ্যাছে / কাল ঘুমে।" তিনি বলতেন, ছবি আঁকতে পারেন না বলেই কবিতায় বা সিনেমায় দৃশ্য তৈরি করেন। আর এই সমস্ত দৃশ্যই একেবারে তাঁর নিজস্ব। সবই যে তাঁর ছেলেবেলার স্মৃতি।

সিনেমার সঙ্গে যোগাযোগ কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়ার সময়। অর্থনীতির ছাত্র হয়েও তখন প্রায়ই পৌঁছে যেতেন ‘কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি’-তে। সেখানে তখন চাঁদের হাট। ঋত্বিক, সত্যজিৎ, মৃণালদের নিয়মিত যাওয়া আসা। সেখানে বসেই দেখেছেন লুই ব্যুনুয়েল বা বার্গম্যানের সিনেমাও। ব্যুনয়েলের চিত্রকল্প ও রূপক নির্মাণ গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল তাঁকে।

সারা জীবনে চলচ্চিত্র পরিচালনার জন্য পেয়েছেন অসংখ্য সম্মান। দ্বিতীয় ছবি ‘বাঘ বাহাদুর’-ই জাতীয় পুরস্কারের আসরে সেরা চলচ্চিত্রের শিরোপা তুলে নেয়। ‘উত্তরা’ ও ‘স্বপ্নের দিন’-এর জন্য পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ পরিচালকের সম্মান। পাশাপাশি দেশবিদেশের নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। ভেনিস, বার্লিন, লোকার্নোর মতো চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। অ্যাকাডেমি অফ মোশন পিকচার্স অ্যান্ড সায়েন্স বা অস্কারের বিশ্ব চলচ্চিত্র ইতিহাসের বিশেষ তথ্যপঞ্জিতেও নথিভুক্ত হয়েছে তাঁর জীবন। কিন্তু বিদেশের মাটিতে যতটা সম্মান পেয়েছেন, বাঙালি দর্শকের কাছে সেভাবে পৌঁছয়নি তাঁর সিনেমা। তার জন্য অবশ্য আক্ষেপ করেননি বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। তবে যে ভাষার, যে মানুষদের নিয়ে তিনি সিনেমা বানান, তাঁর দেখলে ভালো লাগত, এটুকুই। ২০১৯ সালে ‘উড়োজাহাজ’ সিনেমাটি অবশ্য বাংলার বেশ কিছু প্রেক্ষাগৃহে জায়গা পায়। হয়তো কোনোদিন পুরনো রিল খুঁজে বাঙালি দর্শক আবারও ফিরে দেখবেন তাঁর সিনেমা। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত যে মনে করতেন প্রকৃত শিল্পের কোনো নির্দিষ্ট সময় থাকে না। তা ৬০ বছর পরেও সমান প্রাসঙ্গিক।

তথ্যসূত্রঃ আমি প্রেমে ডুবে থাকা এক মানুষ: বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, সাক্ষাৎকারে স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দবাজার পত্রিকা
বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর সঙ্গে, সাক্ষাৎকারে শুভদীপ মৈত্র, কালি ও কলম

Powered by Froala Editor