জিআই তকমা পেতে চলেছে বাংলার কালো-নুনিয়া ধান, অন্তিম স্বীকৃতির অপেক্ষা

ধানের দেশ বাংলা। অথচ এখানে যে নানা জাতের ধানের চাষ হয়, তার প্রায় কোনোটারই জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন বা জিআই তকমা নেই। ইতিমধ্যে তুলাইপঞ্জী সহ বেশ কিছু ধানের জিআই-এর জন্য আবেদন জানানো হয়েছে। আর এবার সেই তালিকায় নাম লেখালো উত্তরবঙ্গের বিখ্যাত কালো-নুনিয়া ধান। উত্তরবঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্টেট এগ্রিকালচারাল ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড এক্সটেনশন ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে মিলিতভাবে জিআই-এর জন্য আবেদন জানানো হয়েছে। ইতিমধ্যে সেই আবেদন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে রাজ্যের কৃষি দপ্তর।

“জিআই পেতে তকমা পেতে গেলে প্রথমেই প্রমাণ করতে হয় যে এই প্রোডাক্টটি নির্দিষ্ট অঞ্চলেই তৈরি হয়। বা সেই নির্দিষ্ট অঞ্চলের জনজীবনের সঙ্গে তার গভীর যোগাযোগ আছে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন গবেষণাপত্র থেকে প্রয়োজনীয় উপাদান সরবরাহ করা হয়েছে। তাছাড়া, জলপাইগুড়ি এবং কোচবিহারের লোকজীবনের সঙ্গে এই চালের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবির। এমন সুগন্ধী চাল খুব কমই পাওয়া যায়।” বলছিলেন চুঁচুড়া ধান্য গবেষণাকেন্দ্রের প্রবীণ গবেষক ডঃ বিজন অধিকারী। জিআই তকমা পেলে বাংলার এই ঐতিহ্যশালী ধানের ব্যবসা আরও মজবুত হবে বলেই মনে করেন তিনি। “এর ফলে নির্দিষ্ট ভৌগলিক অঞ্চলের বাইরে আর কোথাও এই প্রজাতির ধান চাষ করা যাবে না। ফলে কৃষকদের অর্থনৈতিক সুবিধা আসবেই।” বলছিলেন তিনি।

উত্তরবঙ্গ ও তরাই অঞ্চলে বেশ কিছু বিশেষ ধরণের আমন ধানের চাষ হয়। তারই একটি কালো-নুনিয়া। মাঝারি মাপের গাছের উপর সরু এবং লম্বা ধানগুলির রং হয় কালো। তাই এমন নাম। তবে ধানের ভিতরে যে চাল থাকে, তার রং সাদাই। এবং সেই চাল ফোটালে তার গন্ধে আশেপাশের মানুষ মাতোয়ারা হয়ে যান। “কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের সময় এই ধানের চাষ হত। এবং এই চালের তৈরি পায়েস মদনমোহন মন্দিরে ঠাকুর মদনমোহনকে ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হতে। আজও মদনমোহনকে কালো নুনিয়া চালের পায়েস দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। সুগন্ধি কালো নুনিয়া চালের গরম ভাত। সঙ্গে ঘি, কাঁচা লঙ্কা, ছাঁকা তেলে ভাজা বেগুনি, ভোজন রসিকদের জিভে জল আনতে বাধ্য।” বলছিলেন ধান্য গবেষণাকেন্দ্রের মৃত্তিকাবিজ্ঞানী ডঃ কৌশিক মজুমদার। আজও পিঠে এবং পায়েস তৈরিতে এই চালের ব্যবহার ব্যাপক। তবে ফলন নিয়ে সমস্যা ছিল দীর্ঘদিন। কৌশিক মজুমদার জানালেন, “অন্য ধান যেখানে বিঘায় ১৪ মনের বেশি পাওয়া যেত, এই ধান পাওয়া যেন ৫ মনের কম। কিন্তু ইদানিং সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে চাষ করেও বিঘা প্রতি ১২ মনের বেশি ধান পাওয়া যাচ্ছে।” আর বাজারে এর দামও যথেষ্ট বেশি। ফলে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে ক্রমশ কালো-নুনিয়া ধান জায়গা করে নিচ্ছে নতুন করে।

কালীপ্রসন্ন সিংহের মহাভারতে উল্লেখ আছে, পাণ্ডবরা বনবাসে থাকার সময় উত্তরবঙ্গে এসে এই চালের চাষ শুরু করে। কালো রঙের এই চালের জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে নানা লোককথা ছড়িয়ে আছে কোচবিহার এবং জলপাইগুড়িতে। কীভাবে এর চাষ শুরু হল, তার ইতিহাস জানা নেই। কিন্তু এই ধান যে বাংলার নিজস্ব সম্পদ, তাতে সন্দেহ নেই। রাজ্য তো সবুজ সংকেত দিয়েছে। এখন অপেক্ষা শুধু কেন্দ্রীয় ইন্ট্যালেকচুয়াল প্রপার্টি রাইট অফিস থেকে অন্তিম স্বীকৃতি আসার।

আরও পড়ুন
স্বীকৃতির খোঁজে বাংলার ঐতিহ্যবাহী মসলিন, আবেদন জিআই-এর

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
জিআই ট্যাগের অপেক্ষায় নতুনগ্রামের কাঠের পুতুল, শক্তিগড়ের ল্যাংচা

More From Author See More