উপন্যাসের জন্য চাকরি খুইয়েছেন অজিত রায়, হতে হয়েছে ঘরছাড়াও

একসময় বাংলার সীমানার মধ্যেই ছিল ধানবাদ শহর। সেখানে বাঙালির সংখ্যাও কম ছিল না। কিন্তু তারপরেও মানভূম আন্দোলনের সময় থেকেই বাংলার সঙ্গে ধানবাদের একটা দূরত্ব তৈরি হয়। শহরের বুকে তখনও থেকে যাওয়া বাঙালিদের কথাই উঠে এল ১৯৯৬ সালে, বইয়ের পাতায়। ‘ধানবাদ ইতিবৃত্ত’ উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে একটা ঝড় তুলে দিয়েছিলেন সাহিত্যিক অজিত রায় (Ajit Roy)। ঝড় উঠেছিল ব্যক্তিগত জীবনেও। এই উপন্যাসের জন্যই তাঁকে চাকরি খোয়াতে হয়। দীর্ঘ তিনমাস ঘরছাড়া হয়েও থাকতে হয়েছিল তাঁকে। অবশেষে তখন থেকেই পুরোপুরি লেখালেখির জগতে প্রবেশ। তারপর গত ২৫ বছর ধরে অজিত রায়ের কলম থেমে থাকেনি। বলা ভালো, উপন্যাস থেকে শুরু করে নানা প্রবন্ধমালায় বাংলা ভাষার রহস্যকে নতুন করে চিনতে শিখিয়েছেন তিনি।

বাংলা সাহিত্যের ব্যতিক্রমী সাহিত্যকদের একজন অজিত রায়। সাহিত্যের পাশাপাশি ভাষার গবেষণাতেও তিনি ব্যতিক্রমী। আশির দশকে সাহিত্যের জগতে আত্মপ্রকাশ। তারপর নব্বইয়ের দশক থেকে তিনি সাহিত্যের ফুলটাইমার। বয়স হয়েছিল। শরীরে বাসা বেঁধেছিল নানা অসুখ। দীর্ঘদিন ধরেই হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। কথা ছিল, আর কিছুদিনের মধ্যেই ফিরে আসবেন। আবার কলম ধরবেন। কিন্তু ফিরে আসা আর হল না। আজ সন্ধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন অজিত রায়।

ধানবাদের ভূমিপুত্র অজিত রায়। ১৯৬২ সালের ১৫ জুলাই শহরের সিএফআরআই কলোনিতে জন্ম তাঁর। রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর আইন নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। চাকরি করেছেন একটি কয়লা মার্চেন্ট অফিসের অ্যাকাউন্টেন্ট হিসাবে। তবে সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ ছিল ছোটো থেকেই। স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে মিলে একসময় প্রকাশ করেছেন ‘অনন্যা’ নামের একটা কবিতা। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বৃহত্তর পাঠকের সামনে আত্মপ্রকাশ করেন অজিত রায়। তখন অবশ্য তিনি ছিলেন কবি। অবশ্য নিজের প্রথম কবিতার বইয়ের নাম রেখেছিলেন ‘অকবিতা’। কবিতার বইয়ের মধ্যেই অজিত রায় প্রমাণ করে দিয়েছিলেন, গতানুগতিক সাহিত্যের ভাষা থেকে বেরিয়ে অন্যরকম কাজ করতে চান তিনি। পরবর্তীকালে কবিতাকে ছেড়ে গদ্যসাহিত্যকে আশ্রয় করে নিলেও তার মধ্যে কবিতার নানা প্রভাব সবসময়ই লক্ষ করা গিয়েছে।

অজিত রায়ের সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য অবশ্যই সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধকে ভেঙেচুরে দেওয়া। এই কারণেই তিনি নন্দিত, আবার নিন্দিতও। ‘যোজন ভাইরাস’ বা ‘জোখিম কোরকাপ’ উপন্যাসে সভ্য মানুষের ভিতর লুকিয়ে থাকা পাশবিক চরিত্রগুলিকে যেভাবে তুলে ধরেছেন তিনি, তাতে সত্যিই চমকে উঠতে হয়। তেমনই মানুষের যৌন আকাঙ্খার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিতে গিয়েও কখনও তাঁর কলম থমকে যায়নি। তিনি লিখেছেন সৃষ্টির আনন্দে, সত্যের সাহসে। তারপর মানুষ সেটা গ্রহণ করবেন কিনা, তাই নিয়ে ভাবেননি।

অজিত রায়ের খোলামেলা লেখার সামনে ইতস্তত করেন পাঠক। কিন্তু তাঁর ব্যতিক্রমী কাজকে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় থাকে না। পাঠক তাঁর সাহসের নিন্দা করুন বা প্রশংসা, তাঁকে এড়িয়ে যেতে পারবেন না। এড়িয়ে যেতে পারবেন না তাঁর গবেষণাধর্মী কাজকেও। তার কিছুটা আভাস যেমন ছড়িয়ে রয়েছে ‘কৌরব ও পাপারাৎজি’ বা ‘ম্যাওড়া জোন’ উপন্যাসে, তেমনই অনেকটা রয়েছে ‘শহর’ পত্রিকার নানা সংখ্যায়। তার মধ্যে ‘বাংলা স্ল্যাং’, ‘যৌনতা’, ‘পাগল সংখ্যা’, ‘আত্মজীবনী সংখ্যা’-র মতো রয়েছে নানা ব্যতিক্রমী বিষয়। লিখেছেন ‘ছোটলোকের শব্দলোক’, ‘যৌনতা সমুচ্চয় তত্ত্বতালাস’, ‘বাংলা স্ল্যাং’ প্রভৃতি গবেষণামূলক গ্রন্থ। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কলম ছাড়েননি তিনি। এই মাসেই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা থ্রিলার উপন্যাস ‘ঘামলাঘাট’। আর এর মধ্যেই এসে পড়ল অপ্রত্যাশিত মৃত্যু সংবাদ। আচমকা এই সংবাদে স্তব্ধ পাঠককূল। অজিত রায়ের মৃত্যু বাংলা সাহিত্যের একটা অধ্যায়ের সমাপ্তি।

Powered by Froala Editor

More From Author See More