থেমে গেল সমস্ত লড়াই, প্রয়াত কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

শেষরক্ষা হল না কোনোভাবেই। প্রায় দেড় মাস ধরেই অক্লান্ত চেষ্টা করে গেছেন চিকিৎসকরা। সঙ্গে ছিল অসংখ্য অনুরাগীর প্রার্থনাও। তবুও শেষ অবধি বিদায় নিলেন কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। রবিবার সকাল ১২.১৫-এ কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালে সমস্ত লড়াই শেষ হয় বর্ষীয়ান এই অভিনেতার। হাসপাতালের চিকিৎসকরা ঘোষণা করেন তাঁর প্রয়াণসংবাদ।

গত অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে করোনাকে হারিয়েই সুস্থতায় ফিরে এসেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। কথা বলা, পছন্দের গান শোনা একরকম স্বস্তিই দিয়েছিল চিকিৎসকদের। তবে কিছুদিনের মধ্যেই দেখা দিয়েছিল স্নায়বিক সমস্যা। ধীরে ধীরে প্রতিক্রিয়া দেওয়াও বন্ধ করেছিল মস্তিষ্ক। শুরু হয়েছিল অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ। সেইসঙ্গে ছিল কোভিড এনসেফ্যালোপ্যাথি। যা ডাক্তারদের চিন্তায় রেখেছিল...  

বৃহস্পতিবার জ্বর এলেও তা নিয়ে সেইভাবে চিন্তিত ছিলেন না চিকিৎসকরা। এনসেফালোপ্যাথির জন্য এর মধ্যে বেশ কয়েকবারই বদল করতে হয়েছিল তাঁর প্লাজমা। মনে করা হয়েছিল তার জন্যই এইধরণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। চিকিৎসকদের আশা ছিল এর পর হয়তো স্বাভাবিক স্থিতিশীলতায় ফিরবেন তিনি। তবে শুক্রবার আরও অবনতি হয় অবস্থার। মস্তিষ্কের চেতনামাত্রা নেমে আসে ৯-১০ থেকে মাত্র ৫-এ। এদিন তা ৩-এ নেমে এলে ব্রেনডেথ হিসাবে ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।

১৯৩৫ সালে কলকাতা শহরের বুকে মির্জাপুর স্ট্রিটে জন্ম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। তবে শৈশব কৈশোরের প্রায় পুরো সময়টাই কেটেছে নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে। বাড়িতে যদিও প্রথম থেকেই নাটকে অভিনয়ের রেওয়াজ ছিল। সেই সূত্রেই জড়িয়ে পড়া অভিনয়ের সঙ্গে। এরপর কলকাতায় এসে পরিচয় হল শিশির কুমার ভাদুড়ীর সঙ্গে। শুরু হল একের পর এক রঙ্গমঞ্চে অভিনয়। বয়সের বেড়া টপকে কাছাকাছি এসেছিল দুই কিংবদন্তির সম্পর্ক। কিন্তু নাটকে অভিনয় করে উপযুক্ত উপার্জন হয় না। তাছাড়া কবিতার প্রতিও আগ্রহ ছিল সেই ছেলেবেলা থেকেই। তাই যোগ দিলেন রেডিওতে।

সিনেমায় আসার রাস্তাটা প্রথমেই খুব সহজ হয়নি। প্রথম সিনেমার জন্য অডিশন দিতে গিয়ে স্ক্রিন টেস্টে বাদ পড়েন তিনি। কিন্তু এরপরেই তাঁকে আবিষ্কার করেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়। পথের পাঁচালির পর অপুকে নিয়ে আরও একটি সিনেমার চিত্রনাট্য তখন প্রস্তুত। শুধু অপুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সেই প্রথম আত্মপ্রকাশ বড়ো পর্দায়। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত শুটিং ফ্লোরে অভিনয় করে গিয়েছেন তিনি। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে সারা জীবনে ১৪টি সিনেমায় কাজ করেছেন। এমনকি ফেলুদার গল্পের অলঙ্করণ করতে গিয়েও যেন বারবার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কেই এঁকেছেন সত্যজিৎ রায়। তাছাড়া হীরক রাজার দেশের উদয়ন পণ্ডিতের কথাই বা বাদ যায় কী করে?

সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ করতে করতেই একেবারে বাণিজ্যিক ধারার সিনেমাতেও একইভাবে অভিনয় করে গিয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সিনেমায় অভিনয় শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই ডাক এল ‘স্ত্রী’ সিনেমার জন্য। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সেই সিনেমায় অন্যতম বড় একটি ভূমিকায় আছেন স্বয়ং উত্তম কুমার। অথচ কোথাও আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা যায়নি সদ্য আসা সৌমিত্রের মধ্যে। একের পর এক অভিনয় করেছেন, ‘তিন ভূবনের পারে’ বা ‘বসন্ত বিলাপ’-এর মতো সিনেমায় রোমান্টিক নায়কের চরিত্রে। আবার ‘ঝিন্দের বন্দি’, ‘অগ্রদানী’, ‘গণশত্রু’-তে তাঁকে দেখা গিয়েছে ব্যতিক্রমী চরিত্রেও। পেয়েছেন দাদাসাহেব ফালকে সহ দেশবিদেশের নানা পুরস্কার।

আরও পড়ুন
চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছেন না সৌমিত্র, বিকল কিডনিও

গত ৬ অক্টোবর করোনা আক্রান্ত হয়েই বেলভিউ নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। প্রাথমিকভাবে মনে করা হয়েছিল, শুটিং ফ্লোর থেকেই কোনোভাবে ছড়িয়েছে সংক্রমণ। বয়সের কারণেই সম্ভবত ভাইরাস তাড়াতাড়ি বাসা বেঁধেছিল শরীরে। কোভিডের সূত্র ধরেই শরীরে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল একাধিক রোগ। ক্যানসার ছড়িয়ে পড়েছিল শরীরে, মস্তিষ্কে। দেখা দিয়েছিল কিডনির সমস্যাও। তবে বার বার সুস্থতার আশা জাগিয়েও শেষ অবধি চিকিৎসায় সাড়া দিল না তাঁর শরীর। শুরুর দিন থেকেই তাঁর চিন্তায় উদ্বিগ্ন হয়ে ছিলেন বাংলা সিনেমার আপামর দর্শক। ফাঁক ছিল না প্রার্থনাতেও। তাঁর চলে যাওয়া ঘিরেই এখন শোকস্তব্ধ টলিপাড়া। ভিজে অনুরাগীদের চোখও...

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More