অপরিচিত কণ্ঠে হঠাৎ গুনগুন, চলন্ত ট্রামেই নিজের গান শুনতে পেলেন আব্বাসউদ্দিন

কলকাতা রেডিও স্টেশনের ভেতর চলছে জমজমাট আড্ডা। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ঘর আলো করে বসে আছেন আব্বাসউদ্দিন। সবাই মেতে উঠেছেন সেখানে। হঠাৎই ঘরের অন্যদিকে চোখ গেল আব্বাসউদ্দিনের। এক তরুণ চুপচাপ বসে আছে। পরিচয় জানার পর অবাকই হয়ে গেলেন তিনি। কয়েকদিন আগে, ডুয়ার্সে বেড়াতে গিয়ে তাঁর রেকর্ড শুনেছিলেন। প্রথম রেকর্ড তরুণটির; আর সেই গান শুনে মোহিত হয়ে গেলেন একেবারে। তরুণটি রেডিও স্টেশনে অডিশন দিতে এসেছেন। একফাঁকে তাঁকে ডেকে নিলেন আব্বাসউদ্দিন। তাঁর বিশ্বাস, এই ছেলের যা গলা, তাই দিয়ে শুধু বঙ্গদেশ নয় গোটা ভারত শাসন করবে। এই কথা শুনে হাঁ করে আব্বাসের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন তরুণ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। বিস্ময় যেন কাটতেই চাইছে না… 

সেভাবে সঙ্গীতের প্রথাগত শিক্ষা ছিল না আব্বাসউদ্দিনের। কিন্তু তাঁর গলায় প্রাণ ছিল; এক আকুতি, যা বাংলার প্রতিটা মাঠে ঘাটে পৌঁছে যেত। অবিভক্ত বাংলার কোচবিহারের গ্রামেই বেড়ে উঠেছিলেন, আর সেই বীজ নিজের ভেতর বয়ে নিয়ে গেছেন আজীবন। তাঁর সুরে প্রাণ পেয়েছে বাংলার লোকগান। সেখানে যেমন আছে পল্লিগীতি, তেমনই আছে ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, সারি ইত্যাদি গানগুলি। বাংলাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী জেমস ঠিকই বলেছিলেন, ‘সুরের পাখি আব্বাসের দরদভরা সেই গান’। আর সেই সুরই আব্বাসউদ্দিনের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে; মিলিয়ে দিয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও… 

তখন আব্বাসউদ্দিন রাইটার্স বিল্ডিংয়ে রেকর্ডিং এক্সপার্ট হিসেবে কাজ করছেন। ১৯৪১-এর ৭ আগস্ট। হঠাৎই অফিসে খবর এল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর নেই। কিছুক্ষণ আগেই ধরাধাম ত্যাগ করেছেন। এক মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেলেন আব্বাসউদ্দিন। এ কি শুনলেন তিনি! যে দেবতা তাঁর জীবনকে ভরিয়ে রাখলেন, ভেতরে বিরাজ করছেন সবসময়, তিনিই আজ…! ভেবেছিলেন, দিন কয়েকের ছুটি নিয়ে একটু বাড়ি যাবেন। তা আর কী করে হবে? রাস্তায় লোকে লোকারণ্য। এদিকে আব্বাসও যে আর নিজের মধ্যে নেই… 

এমন সময় কলকাতা রেডিও স্টেশন থেকে ফোন এল অফিসে। ওপারে স্টেশনের ডিরেক্টর নৃপেন মজুমদার। চলে আসতে বললেন কলকাতা রেডিওতে। যে পথটুকু তাড়াতাড়ি চলে যেতেন, সেটাই তখন মনে হচ্ছে অনন্তের যাত্রা। লালদিঘির ধারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে আছেন আব্বাস। কোনোমতে বিকেলের দিকে ঢুকলেন রেডিও ভবনে। অনুরোধ এল একটি গান গাওয়ার। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে মাথায় কিচ্ছু আসছিল না তাঁর। একসময় গেয়ে উঠলেন, ‘ওই যে ঝড়ের মেঘের কোলে, বৃষ্টি আসে মুক্তকেশে…’। ঠিক সেই সময়ই কবিগুরুকে চিতায় তোলা হল; আর অদ্ভুতভাবে তখনই শুরু হল বৃষ্টি। আর সবকিছুর সঙ্গে মিলে গেল আব্বাসউদ্দিনের গান। অজান্তেই গেয়ে উঠেছিলেন বর্ষার সুর, আর সেই বৃষ্টিই নেমে এল কবিগুরুর নিথর শরীরে… 

এর বাইরেও আব্বাসউদিনের সঙ্গে জুড়ে রয়েছেন আরও একজন— কাজী নজরুল ইসলাম। তখন বেশ কিছু গান লিখে ফেলেছেন তিনি। রেকর্ডও বেরিয়ে গেছে সেসবের। কিন্তু নজরুলের ওপর যেন ক্ষেপে উঠেছে তৎকালীন মুসলিম সমাজ। উঠতে বসতে আক্রমণ ধেয়ে আসছে। এমন সময় আব্বাসের নজর গেল উর্দু কাওয়ালির দিকে। আচ্ছা, এরকমভাবে যদি বাংলায় ইসলামি গান তৈরি হয়? মনের কথাটা পেড়েই ফেললেন নজরুলের কাছে। তিনিও মত দিলেন এতে। কিন্তু গ্রামোফোন কোম্পানির কাছে কথা পাড়তে গিয়ে হল বিপদ। তাঁরা কিছুতেই এই গান রেকর্ড করবেন না। তাহলে উপায়? 

আব্বাসউদ্দিন হার মানলেন না। আরেকদিন গেলেন রেকর্ডিং কোম্পানির রিহার্সাল-ইন-চার্জ ভগবতী ভট্টাচার্যের কাছে। যদি রাজি করানো যায় তাঁকে। এমন নাছোড়বান্দা মনোভাব দেখে রাজি না হয়ে থাকা যায়! পাশের ঘরেই ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। সঙ্গে সঙ্গে সেই খবর নিয়ে গেলেন আব্বাসউদ্দিন। কিছুক্ষণের মধ্যেই গান লিখে ফেললেন নজরুল। পরপর দুটো গান— ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে’, আর ‘ইসলামের ওই সওদা লয়ে’। চারদিনের মধ্যেই রেকর্ড করা হল, গায়কের আসনে স্বয়ং আব্বাসউদ্দিন। সেই তাঁর প্রথম গাওয়া ইসলামি গান… 

আরও পড়ুন
দুর্গার জন্য গান স্যালুট; কলকাতার ‘বন্দুকওয়ালা বাড়ি’তে অভিনব অভ্যর্থনা দেবীর

আর ফিরে তাকাতে হয়নি। সেই যে যাত্রা শুরু হল নজরুল-আব্বাসউদ্দিনের, আর থামেনি। বাংলার ইসলামি গানের একটা পরম্পরা শুরু হল এই দুজনের হাত ধরে। ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে’ গানটি আজও পবিত্র ঈদের দিনে বেজে ওঠে সারা বাংলায়। তখনও লোকের মুখে মুখে ফিরত এই গান। একদিন আব্বাসউদ্দিন ট্রামে চড়ে অফিস যাচ্ছেন। হঠাৎই পাশে বসে থাকা এক অপরিচিত যুবক গুনগুন করে উঠল গানটি। গড়ের মাঠে গেছেন, সেখানেও একই দৃশ্য। আব্বাসউদ্দিন অবাক! কী করে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ছে গানটি? আর যারা গাইছিল, তারাও কি চিনতে পেরেছিল ‘সুরের পাখি’ আব্বাসকে? পরে গানের প্রচারের জন্য অনেক সস্তায় বাংলাদেশের রেকর্ড কোম্পানিকে দিয়ে দিয়েছিলেন গানগুলো। না, লাভের চিন্তা ছিল না তাঁর। সারাজীবন অত টাকা টাকা করলে হবে? গানগুলোকেও তো ছড়াতে হবে! এমনই ছিলেন আব্বাসউদ্দিন। মাটির মতোই… 

কাহিনির শেষপর্যায় আরও একজন বাঙালি হাজির হবেন। এঁর যাত্রাও শুরু হয়েছিল ওপার বাংলা থেকে। তিনি শচীন দেববর্মণ। তাঁর গানের কাছে বারবার ফিরে যেতেন আব্বাসউদ্দিন। শচীনকর্তাও তো লোকগানের ধারাকে তুলে ধরেছিলেন। তাঁর আনুনাসিক কণ্ঠে সেসব গান আজও কি ভুলতে পেরেছি? নিজের জীবনকালে ভুলতে পারেননি আব্বাসউদ্দিনও। তবে তাঁর থেকেও আগে আসত দুজনের সঙ্গীতযাপন, সুরের সঙ্গে জুড়ে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা। একবার দুজনে মিলে দিনাজপুরে গাইতে গেছেন। আব্বাসউদ্দিনের গাওয়া একটি ভাওয়াইয়া শুনে শচীনকর্তা মজে গেছেন একেবারে। বারবার চেষ্টা করছেন গানটা তুলতে, কিন্তু হচ্ছে না কিছুতেই। একই ঘরে ছিলেন আব্বাসও। তাঁকে যে কতবার গানটি গাওয়ার অনুরোধ করেছিলেন, তার ইয়ত্তা নেই। প্রত্যেকবার একটাই কথা, ‘ও মোর কালা রে কালা’ গানটি গান একবার! আর যতবারই চেষ্টা করছেন, ততবারই শচীনকর্তার গলা দিয়ে বেরিয়ে আসছে হতাশা, “হল না আব্বাস ভাই…”। কী করে যে অমন দরদভরা মোচড় আনছেন গানে, ধরতে পারছেন না তিনি। এই ব্যাকুলতাই এই দুই ব্যক্তির হাত ধরে ফিরে ফিরে এসেছে বঙ্গে। ছুঁয়ে গেছে সেখানকার নদী-মাঠ-ঘাট। আর মেতে উঠেছি সেই মেঠো সুরে… 

তথ্যসূত্র- আমার শিল্পীজীবনের কথা/ আব্বাসউদ্দিন আহমেদ  

আরও পড়ুন
স্বাধীন ভারতে ব্রাত্য আজাদ হিন্দ ফৌজ, অথচ তাদের গানই আজও ব্যবহৃত হয় সেনাবাহিনীতে

Powered by Froala Editor

More From Author See More