কলকাতার কেবিনগুলিতে বসত বিপ্লবীদের বৈঠক, ছিল পালানোর গোপন পথও

খাওয়ার সঙ্গে যুদ্ধের আপাত দৃষ্টিতে কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু ইতিহাস বড়ো অদ্ভুত! কীভাবে অজানা সব দিক একসঙ্গে এসে মিশে যাবে। অন্তত কলকাতার ক্ষেত্রে এটা সত্য। এই শহরের কথা বলতে গেলেই চলে আসবে খাবারের কথা। উঠে আসবে একের পর এক প্রাচীন দোকানের নাম। তারা নিজেরাই ইতিহাসের পাতার অংশ হয়ে আছে আজও। আবার এদের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে স্বাধীনতা আন্দোলনের নানা প্রবাহ। জড়িয়ে আছে সত্তরের উত্তাল সময়…

বিধান সরণি দিয়ে গেলেই চোখে পড়বে কিছু চেনা নাম। বসন্ত কেবিন, ফেভারিট কেবিন, দিলখুসা। চিকেন কাটলেট, কবিরাজি - সহ বিভিন্ন আইটেমের জন্য আজও বাঙালির অন্যতম প্রিয় ডেসটিনেশন। প্রতিটারই বয়স ১০০ ছাড়িয়েছে। ভেতরের আসবাবগুলোয় এখনও লেগে আছে ইতিহাস। ছোট্ট ছোট্ট কাঠের কিউবিকল, সঙ্গে সস্তায় নানা খাবার— এই হল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। সেই তখন থেকে পারিবারিকভাবে চালু হয়ে আসছে কেবিন হোটেলগুলো। আর এই সবগুলোর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে সংস্কৃতি, সংগ্রামের ঘটনা।

যেমন বসন্ত কেবিন। ১৩০ বছর পেরনো এই দোকানটি একদা বিখ্যাত হয়েছিল শিল্পী গণেশ পাইনের জন্য। অবশ্য তার আগে থেকেই ইতিহাসের সাক্ষী থেকেছে এই কেবিন। বিপ্লবীদের গোপন ডেরার মধ্যে এটি ছিল অন্যতম। বিশেষ করে নকশাল আমলে এর প্রসঙ্গ উঠে এসেছে বারবার। বিভিন্ন সিনেমাতেও ছুঁয়ে গেছে বসন্ত কেবিনের নাম। কেবিনগুলোয় গোপন বৈঠক, সেইসঙ্গে সস্তার ভালো খাবার; এমনটাই ছিল ট্রেডমার্ক।

অবশ্য এমন ট্রেডমার্ক একা বসন্ত কেবিন পায়নি। ১৯১৮ সালে নূতন চন্দ্র বড়ুয়া ও গৌড় চন্দ্র বড়ুয়া একটি নতুন দোকান খুললেন কলেজ স্ট্রিটে। মূল ভাবনা সেই কেবিন হোটেলেরই। কম খরচে চা, টোস্ট এবং অন্য কিছু আইটেমের জন্য প্রিয় ছিল এই দোকান। সবার ভরসাও ছিল। দোকানটার নামও ‘ফেভারিট কেবিন’। তবে শুধু সাধারণ মানুষ বা পড়ুয়াদের জন্য নয়, বিপ্লবীদের খাস আড্ডা ছিল এটি। পুলিশের হানাও হত এখানে। বিপ্লবীদের পালানোর জন্য থাকত সেফ প্যাসেজও। ফেভারিট কেবিনের রান্নাঘরে ছিল সেই পালানোর রাস্তা। শুধু বিপ্লবী নয়, সাহিত্যের আড্ডাও বসত এখানে। কল্লোল যুগের লেখকদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল এখানে। আসতেন কাজী নজরুল ইসলাম, প্রেমেন্দ্র মিত্র। আজও একটি বিশেষ টেবিলের ওপরে নজরুল ইসলামের ছবি টাঙানো আছে। জীবদ্দশায় এখানে এলে, এই টেবিলেই বসতেন তিনি!

১১৮ বছরের দিলখুসা কেবিনও এই তালিকার বাইরে নয়। কবিতায়, বিপ্লবে সবসময় জড়িয়ে থাকে প্রেম। এই কেবিনের গল্প তাই অসম্পূর্ণ ভালোবাসা ছাড়া। কত যাত্রা শুরু হয়েছে এখানে, কত কিছু ভেঙে গেছে এই ঘুপচি কেবিনে। স্বপ্ন, আশা, হতাশা— ইতিহাসের আঁচে যেন প্রতিনিয়ত সেঁকে উঠছে এগুলো। কলকাতার অস্তিত্বের সঙ্গেও যে জুড়ে আছে এরা। ফিস ফ্রাই, কবিরাজি, কাটলেটের সঙ্গে বড় হচ্ছে সেসব গল্পও। জিয়ানস্টালে জড়িয়ে আছি যে সবাই! কে বলে, খাবারের সঙ্গে ইতিহাস জড়িয়ে নেই! একবার আসুন এখানে, ছুঁয়ে দেখুন গল্পগুলো…

ছবি - দি বেটার ইন্ডিয়া

Powered by Froala Editor