বন্ধুত্বে বাধা নয় দূরত্ব – চেন্নাইয়ের কাছিম ও এক প্রবাসী ভারতীয়ের সম্পর্কের গল্প

সুদূর ফিনল্যান্ডে থাকে একটি আট বছরের ছোট্ট মেয়ে। জন্মসূত্রে সে ভারতীয়। তবে ভারতবর্ষে আসেনি কোনোদিন। তবে ভারতবর্ষেই আছে তার একটি বন্ধু। বয়সে মেয়েটির থেকে একটু বড়ো। ওদের দেখা হয়নি কোনোদিন। কিন্তু ফিনল্যান্ডে বসেও বন্ধুর কথা ভাবে সে। মাদ্রাজের একটি ক্রোকোডাইল ব্যাঙ্কে আছে তার বন্ধু। সেখানে মেয়েটির নামে একটি ফলকও আছে। ও বলতে ভুলে গিয়েছি, বন্ধুটি মানুষ নয়। সে একটি কাছিম। অত্যন্ত বিরল প্রজাতির কাছিম। মাথায় লাল রঙের টিকার জন্য নাম রেড-ক্রাউন কাছিম। পৃথিবীতে এদের সংখ্যা খুব অল্পই। উপযুক্ত সংরক্ষণের ব্যবস্থা না করলে আর কিছুদিনের মধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে এই প্রজাতিটি।

আরও পড়ুন
সমুদ্র থেকে কার্বন অপসারণ করবে সার্চ ইঞ্জিন, অভিনব উদ্যোগ অস্ট্রেলিয়ার প্রযুক্তিবিদের

মানুষের একচেটিয়া আগ্রাসনের মুখে পড়ে তো বিপন্ন বহু প্রাণীই। অথচ একটু চেষ্টা করলেই প্রত্যেকে মিলেমিশে থাকা যেত। অন্তত এরকম একটা ভাবনা অনেক মানুষের মাথাতেই এসেছে। জীবজন্তুর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক যাতে সহজ বন্ধুত্বের হয়, সেজন্য ছোটো থেকেই সচেতনতা গড়ে তুলতে চেয়েছেন অনেকে। মূলত এরকম একটা উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখেই তৈরি হয়েছিল একটি তামিল অ্যানিমেশন মুভি 'মুড়ালাই'। বাংলায় যার অর্থ 'বন্ধু কুমির'। সেটা ১৯৮৭ সাল। কচিকাঁচা দর্শকদের মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল সেই সিনেমা। এমনকি ৩৩ বছর পর আজও সেই সিনেমাকে ঘিরে তৈরি হচ্ছে আরেক বাস্তব গল্প।

আরও পড়ুন
চোরাশিকারীর হাতে খুন পৃথিবীর শেষ মহিলা সাদা জিরাফ

আজকের গল্পের মুখ্য চরিত্র পার্থিবন। তার বাবা অমরাসীগমনি একজন বাচিক শিল্পী হিসাবে কাজ করেছিলেন ১৯৮৭-র সিনেমাটিতে। সিনেমায় দেখানো মানুষ আর কুমিরের বন্ধুত্ব মন ছুঁয়ে গিয়েছিল তাঁর। আর তার প্রভাব পড়েছিল ছোট্ট পার্থিবনের উপর। ছোট থেকেই তাই এদেশের নানা জীবজন্তুর প্রতি তার এক অদ্ভুত আকর্ষণ। সেই টান থেকে গেছে আজও। পার্থিবন এখন থাকেন সুদূর ফিনল্যান্ডে। কিন্তু মাদ্রাজ ক্রকোডাইল ব্যাঙ্কের একটি বিজ্ঞাপন আজও তাঁকে উদ্বেলিত করে।

আরও পড়ুন
সিংহী মায়ের কোলে সদ্যোজাত চিতাবাঘ, বিরল ‘মানবতা’র সাক্ষী গির অরণ্য

মাদ্রাজ ক্রকোডাইল ব্যাঙ্ক বিলুপ্তপ্রায় সরীসৃপদের সংরক্ষণের কাজ করে। আর্থিক সম্বল খুব বেশি না। তাই দেশবিদেশের বহু মানুষকে তারা আহ্বান জানায়, প্রত্যেকে যদি একটি করে প্রাণীর ভরণপোষণের দায়িত্ব নেয়। এই সামান্য সহযোগিতাটুকু পেলেই হয়তো কিছু প্রাণীকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচানো যাবে। সোশ্যাল মিডিয়াতে তেমনই একটি বিজ্ঞাপনে চোখ আটকে যায় পার্থিবনের। আর তারপরেই দত্তক নিয়ে নেন একটি রেড-ক্রাউন কাছিমকে। প্রায় বিলুপ্তির দিকে যেতে বসা এই প্রজাতিটির একটি প্রাণী ২০১২ সাল থেকে আছে মাদ্রাজ ক্রক ব্যাঙ্কের কাছে।

আরও পড়ুন
লাগানো হল কৃত্রিম পালক, ওড়ার স্বপ্ন নিয়ে ডানা মেলছে মৃতপ্রায় টিয়াপাখি

পার্থিবনকে আকর্ষণ করেছিল ২০১২ সালটাই। সে-বছরই জন্মেছে তাঁর মেয়ে আধ্যা। কাছিমটি দত্তক নেওয়া আসলে মেয়ের জন্য একটি ছোট্ট উপহার। উপহার পেয়ে খুশি আধ্যাও। এভাবেই ছোট থেকে আধ্যাকে জীবজন্তুর প্রতি উৎসাহী করে তুলতে চান পার্থিবন। তাঁর বাবাও তো সেই চেষ্টাই করেছিলেন। আর্থিক সাহায্যটাই সবসময় বড় হয়ে ওঠে না। জীবজন্তুর প্রতি সহমর্মী অনুভবটুকুই আজ ভীষণ দরকার। এই পৃথিবীর প্রতিটা পরিবার যদি আধ্যার পরিবারের মতো হত, পৃথিবীটা তাহলে সত্যিই অনেকটা অন্যরকম হত। অনেক প্রাণীকেই আজ আর বিলুপ্ত হওয়ার অপেক্ষায় দিন গুনতে হত না।

More From Author See More