‘কে কী বলল ভাবা অনর্থক, লেখা খারাপ হলে ১০ লাখ টাকা উঠতই না’ – অভীক দত্তের সাক্ষাৎকার

সম্প্রতি নিজের লেখা পিডিএফ বিক্রি করে চারদিকে আলোড়ন ফেলে দিয়েছেন তিনি। বাংলায় লেখালিখি করে, নিজের বই বিক্রি করে মাত্র দেড় মাসেই ১০ লক্ষ টাকা সংগ্রহ – মুখের কথা নয়। সেই টাকা তিনি অনুদান হিসেবে দান করেছেন করোনা ও আমফান-বিধ্বস্ত মানুষদের জন্য। ধেয়ে এসেছে সমালোচনাও। তবে সেসবের ধার ধারেনি কোনোদিনই। তিনি, অভীক দত্ত। সামগ্রিক এই পথচলা নিয়ে, তাঁর সঙ্গে কথা বলল প্রহর...

১। বাংলা বই, তাও আবার পিডিএফ, বিক্রি করে ১০ লাখ টাকা! মাত্র এই ক’দিনে। আপনি কি নিজেও বিশ্বাস করেছিলেন, এমন হবে?

প্রথমের দিকে ভেবেছিলাম এক-দেড় লাখ টাকা হবে। তারপর সাড়া আসতে লাগল। আমার কিছু পাঠক নিয়মিত বলতে লাগল, ‘আপনি লিখুন’। আমি যখন ফেসবুক পেজে জানালাম যে আমি এখানে না লিখে আমার প্রোফাইলে লিখব এবং ত্রাণের জন্য টাকা তুলব, তখন আমার নিয়মিত পাঠকরা সেই পিডিএফ-গুলো কেনা শুরু করল। প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে অন্য লোকেরাও যুক্ত হতে থাকল। যারা আমার লেখা আগে পড়েনি, তারা জানতে পারল। তখন আমি চিন্তা করে দেখলাম, এখন তো দরকার টাকা তোলার। ফলে আমি যতটা পারলাম এগোতে থাকলাম। তারপর ২ লাখ হতে একটু সময় লাগল, ২ থেকে ৩, ৩ থেকে ৪। তারপর শেষ তিন-চার দিনেই বেশি টাকা উঠে এসেছে।

২। বাংলা বই ও প্রকাশনার জগতে এ এক বিপ্লবই বটে। যে-কোনো লেখকই তাহলে এভাবেও পিডিএফ বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করতে পারেন?

এর জন্য একটু টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলো জানতে হবে। টার্গেটটাকে বুঝতে হবে। কারা তাঁর লেখা পড়বেন। বুঝতে হবে মার্কেটিং-ও। কাদের কাদের টার্গেট করছি। আমার পাঠকরা কী চাইছে, আর আমি কী চাইছি; দুটো যখন মিলে করে যায় তখন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এই পলিসি নিলে সবাই সফল হবে।

আরও পড়ুন
দায়িত্বের চাপ নাকি বেহাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, দেবদত্তার মৃত্যু জাগিয়ে দিল অনেক প্রশ্নই

৩। অনেকের অভিযোগ, আপনার লেখা একটা নির্দিষ্ট বয়সের ছেলেমেয়েদের মজিয়ে রাখার জন্য। দীর্ঘ আয়ু পাওয়ার লেখা নয়। এ-ব্যাপারে আপনার কী মত?

এগুলো যাঁরা বলেন, তাঁরা আমার লেখা পড়েননি। যাঁরা এরকম সমালোচনা করেন তাঁরা একপাতা দুপাতা পড়েই বলতে শুরু করেন। তাঁরা আমার বেশিরভাগ লেখা পড়েননি। হয়তো দু-একটা গল্প পড়েছেন। তারপর ভেবেছেন আমি হয়তো এধরনের লেখাই লিখি। আমার ৩০টা বই আছে। সেগুলো যাঁরা পড়েননি তাঁরা জানেন না, আমার অনেক বয়স্ক পাঠক আছেন। কারোর সমালোচনা করার আগে, তাঁকে জানতে হবে ঠিক করে।

৪। এই যে আপনি একটা করে গল্প লিখছেন আর পিডিএফ বিক্রি করছেন, এই নিয়মিত লেখায় কি টাকা তোলাটাই মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে যাচ্ছে না? এতে কি লেখার সাহিত্যগুণের সঙ্গে আপোস হচ্ছে বলে মনে হয় আপনার? 

না, সেরকমটা যদি হত তাহলে আমার প্রথম গল্প যেখানে ১ হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল সেখানে সেটা উত্তরোত্তর বাড়তে শুরু করত না। কোয়ালিটি কম্প্রোমাইজ করলে কেউ শুধু ত্রাণের জন্য টাকা দেন না। সবাই প্রথমত প্রোডাক্টটাই কিনবেন।

আরও পড়ুন
‘আঠেরো বছর বয়সী সোমেন চন্দের লেখার শিল্পশৈলী ভীষণভাবে বিস্মিত করেছে’ : দিলীপ মজুমদার

৫। পরিযায়ী শ্রমিক, আমফান ও অন্যান্য ক্ষেত্রেও আপনি টাকা দিয়েছেন। সম্প্রতি এক তরুণের অসুস্থ বাবার চিকিৎসার জন্যেও অর্থসাহায্য করেছ। এটা করা সম্ভব, শুধুমাত্র নিজের লেখা দিয়েই, এই আত্মবিশ্বাস এল কোথা থেকে?

আমি যখন আফমান এবং করোনার জন্য টাকা তুলে পাঠিয়েছি। তারপর এমন একটা পরিস্থিতি এল, যখন আমাদের অশোকনগরের একটা ছেলে আমাকে জানাল যে রাকেশ সর্দার নামে একটি ছেলের ক্যানসার হয়েছে। সে একেবারে গরিব হতদরিদ্র পরিবারের ছেলে। তখন আমার পাঠকদের জিজ্ঞাসা করলাম, আমি যে টাকা তুলছি সেটা যদি একজন ক্যানসার রোগীর চিকিৎসায় খরচ করি তাহলে কি আপনাদের আপত্তি আছে? তাঁরা জানালেন, না তাঁদের কোনো আপত্তি নেই। তখন রাকেশের জন্য একটা পিডিএফ করলাম। তারপর ওই একটা সপ্তাহেই আমার ১ লাখ টাকা ওঠে এবং আমি পুরোটাই রাকেশের জন্য দিয়ে দিই। তারপর আমাকে একজন বলল, সায়ন্তন অধিকারীর বাবার জন্য কিছু করতে পারি কিনা। প্রথমে আমি আড়াই হাজার টাকা পাঠালাম। যেরকমভাবে এসেছে আমাকে অ্যারেঞ্জ করতে হয়েছে। কারণ বর্ষার আগে সুন্দরবনে ত্রাণ পাঠাতে হবে। অনেকেই তখনও খাবার পাননি। অনেক বাড়িতে ইলেক্ট্রিসিটি নেই, জল নেই। নোনা জল খেয়েই বাঁচতে হচ্ছে। তো ত্রাণের কাজেও টাকাটা দরকার, একইসঙ্গে এখানেও টাকাটা দরকার। তখন আরও বেশি বেশি গল্প লিখতে হয়েছে।

৬। এমন উদ্যোগ নেওয়ার জন্য সবার আগে দরকার অভিজ্ঞতা। আপনার ক্লোজড গ্রুপে লিখে এর আগে উপার্জন করেছেন। সেই অভিজ্ঞতাই কি এমন বড়ো পদক্ষেপ নেওয়ার সাহস যোগাল?

অবশ্যই একটা আত্মবিশ্বাস এসেছে। আমার লেখাটা বিক্রি হচ্ছে নাকি, সেই জায়গাটা বুঝতে হবে। আমি যেটা লিখছি সেটা মানুষ টাকা দিয়ে কিনবে নাকি! মানুষ যখন আমার লেখা কিনে ও পড়ে তৃপ্তি পাবে, তখনই আমি তার উপর ভরসা রাখতে পারব। 

আরও পড়ুন
দেশের কাজে, সমাজের কাজে সোমেন চন্দের ত্যাগ, ঐকান্তিকতা প্রশ্নাতীত : দিলীপ মজুমদার

৭। সম্প্রতি বাংলার এক সাহিত্যিক আপনার এই ১০ লাখ টাকা উপার্জন ও দানে সন্দেহপোষণ করেছেন। আপনার কী বক্তব্য এই ব্যাপারে?

আমার মনে হয়েছে, ওঁর কোনো মানসিক সমস্যা আছে। এমন তো অনেকেই আছেন, যাঁরা মুখে প্রশংসা করছেন, কিন্তু ভিতরে ভিতরে সন্দেহ করছেন। ওই সাহিত্যিক প্রকাশ্যে বলেছেন, বাকিরা বলেননি। কিন্তু আমি জানি আমি কী করেছি। আমি যখন জানি আমার স্পষ্টতা আছে, তো আমার কোনো অসুবিধা নেই। আমার কাছে যদি ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টও আসে, আমি দেখিয়ে দিতে পারব। আমার এখান থেকে টাকা মারার জায়গা নেই। এরকমও হয়েছে যে, আমি আশা করেছি একটা পিডিএফ এতটা বিক্রি হবে, তখন নিজের টাকা থেকে পাঠিয়ে দিয়েছি। পরে টাকাটা উঠে গিয়েছে। আমার কাছে যা এসেছে আমি ধরে ধরে পাঠিয়ে দিয়েছি। সুতরাং কে কী বলল, আমার তাতে অসুবিধা নেই। কিন্তু প্রথমটায় একটু রাগ হয়। পরে মনে হয়েছে উনি হয়তো কোনো সমস্যার মধ্যে আছেন। কিন্তু হুট করে এমন একটা কথা বলে দেওয়ায় একটু খারাপ লাগে।

৮। আপনি যে-উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করলেন, তারপর কি ভালো লেখা অনুশীলনের তুলনায় টাকা উপার্জনেই বেশি মন মজবে না অনেক সাহিত্যপ্রয়াসীর?

যাঁরা কিনবেন তাঁরাও তো জেনেশুনেই কিনবেন। পছন্দ হলেই কিনবেন। এখানে লোভের তো কিছু নেই। কেউ যদি মনে করেন এভাবে উপার্জন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব, তাহলে ঠিক আছে।

আরও পড়ুন
বহুদিন পাশে থাকার মধ্যে যে স্বস্তি, তাই দিতেন ইরফান: নুসরাত ইমরোজ তিশা

৯। এই বিপর্যয়ে বই বিক্রি করে পাশে দাঁড়াচ্ছ – এটা আপনার প্রচারে ছিল সবসময়। আপনার কি মনে হয়, বই বিক্রির মাধ্যমে বিপর্যস্তদের সাহায্য করা – এই আবেগে ফলেই এত টাকা উঠেছে? স্বাভাবিক সময়ে বই বিক্রি করে এই পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ সম্ভব হত?

আমি নিজের বই নিজেই পাঠাই এবং আমার সারা বছর ধরেই প্রচুর বিক্রি হয়। গ্রুপ থেকেই আমি বছরে ৪ লাখ টাকা পাই। হ্যাঁ আমাকে অবশ্যই একটা কন্টিনিউয়াস ক্যাম্পেইন চালাতে হয়েছে। রোজ রোজ মানুষকে বোঝাতে হয়েছে। আজ যেমন ‘অতল হ্রদের রহস্য’ নামে একটা উপন্যাস বেরিয়েছে। আমি যখন টেররিজম নিয়ে কিছু লিখি, প্রচুর বিক্রি হয়। সেটা মাথায় রেখে আমাকে হঠাৎ করে ২ সপ্তাহের মধ্যে এটা লিখতে হয়েছে। কারণ আমি জানি এটা লিখলে আমার টাকাটা বেশি উঠবে। কারণ ঋত্বিকা নামে একটা ৯ বছরের মেয়ের ক্যানসার হয়েছে। তো এদের জন্য আমাকে টাকা তুলতে হবে। কিছু করার নেই। একেকদিন এমনও হয়েছে যে, লিখতে লিখতে অফিসে এসেছি, অফিস থেকে ফিরে আবার লিখতে বসেছি। এই জার্নিটাকে কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। কেউ মানতে না চাইলে আমি শুধু বলতে পারি, আগামী বইমেলায় যখন সৃষ্টিসুখের স্টলে আমার বই বেরোবে তখন একটু খোঁজ নিতে পারেন। গত তিন বছরে আমার যা বই বিক্রি হয়েছে তার রয়্যালটির হিসাব সৃষ্টিসুখ আমাকে পাঠায়। সেটাও খুব একটা কম নয়।

১০। ১০ লক্ষ তো হল। এরপর? পরবর্তী পরিকল্পনা কী?

আমার এই ত্রাণ সংগ্রহের ফেজটা শেষ হয়ে গিয়েছে আগের সপ্তাহেই। এখন আর লিখছি না কিছুই। তবে আমার যে গ্রুপ আছে সেখানে আমি সারা বছর ধরেই লিখি। প্রতিদিন ৫০০ শব্দ লেখা চলতে থাকবে। এর থেকে যে পরিমাণ টাকা আসবে সেটা পুরোটা আমি এর পরেও ত্রাণের কাজেই দেব। এই বছরটা দেব। হয়তো আগামী বছরও দেব। কারণ এই করোনা পরিস্থিতিতে মনে হয় মানুষের টাকাটা দরকার হবে। যদি দেখি সেরকম আর দরকার পড়ছে না, তখন করব না। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত চাহিদাটা থেকে যাবে আমি লিখে যাব।

আরও পড়ুন
“বরুণবাবুর মতো ঋজু না হলেও, আমার অনেকটাই ‘বরুণবাবু’-তে আছে”: অকপট অনীক দত্ত

Powered by Froala Editor

More From Author See More