মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে কলকাতার সঙ্গীতশিল্পীরা, প্রকাশ পেল একের পর এক রেকর্ড

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) উত্তাল জনগণের সামনে এক ‘ঐতিহাসিক ভাষণ’ দিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। ভাষণের শেষে শেখ মুজিব বললেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে প্রায় হয়ে সমার্থক হয়ে যাওয়া নাম শেখ মুজিবর রহমানের এই ভাষণই মূলতঃ স্বাধীনতা লাভের আকাঙ্ক্ষায় অধীর করে তুলেছিল বাঙালিদের; স্বাধীনতার মন্ত্রে নতুন করে দীক্ষিত হয়েছিলেন তাঁরা।

এর ঠিক পরের মাসের ঘটনা। দিনটা ছিল এপ্রিল মাসের ১৩ বা ১৫। পূর্ব পাকিস্তান ততদিনে হয়ে উঠেছে ‘বাংলাদেশ’। কিন্তু এই ঘটনার স্থান বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ কলকাতার পদ্মশ্রী সিনেমা হলের পাশের চায়ের দোকানের একটি আড্ডা। সেই সময় ঐ আড্ডায় উপস্থিত থাকতেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, অংশুমান রায়, দিনেন্দ্র চৌধুরীর মতো মানুষ। যে বিশেষ দিনের কথা বলা হচ্ছে, সেদিন সেই আড্ডায় যোগ দিয়েছিলেন আকাশবাণীর বিশিষ্ট প্রযোজক এবং উত্তরকালের আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের অধিকর্তা উপেন তরফদারও। উপেনবাবু তাঁর সঙ্গে করে সেদিন নিয়ে এসেছিলেন একটি স্পুল রেকর্ডার, যার মাধ্যমে তিনি আড্ডায় উপস্থিত সকলকে শুনিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই ‘ঐতিহাসিক ভাষণ’। সেদিনকার আড্ডার মূল বিষয়বস্তু কেন্দ্রীভূত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর উদাত্ত আহ্বান ও তৎকালীন বাংলাদেশের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির মর্মে। গৌরীপ্রসন্ন সবই শুনছিলেন, আবার মধ্যে মধ্যে যেন একটু অন্যমনষ্কও হয়ে পড়ছিলেন। নানা কথার মধ্যে তিনি তাঁর চারমিনারের প্যাকেটের ভেতরের সাদা অংশটায় কিছু একটা লিখছিলেন। লেখা শেষ হতে তিনি সেটা এগিয়ে দেন দিনেন চৌধুরী ও অংশুমান রায়ের দিকে। লেখাটা পড়ে উচ্ছসিত হয়ে ওঠেন তাঁরা। কী লিখেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন? একটি গান, একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গও বলা চলে – ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে/লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের/ধ্বনি প্রতিধ্বনি/আকাশে বাতাসে ওঠে রনি/আমার বাংলাদেশ…’। 

পড়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অংশুমান রায় গৌরীপ্রসন্ন-র কাছে দাবি করেন, 'গৌরীদা, এটা আপনি আর কাউকে দিতে পারবেন না, এটা আমি সুর করব, আমি গাইব'। অনায়াসেই সে দাবি মঞ্জুর হয়, গৌরীপ্রসন্ন অংশুমানের প্রতিভাকে চিনতেন বিলক্ষণ। 

মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গানের সুর তৈরি করে ফেলেন অংশুমান। স্পুল রেকর্ডারেই সে গান তুলে নেন উপেন তরফদার। অংশুমান রায়ের কণ্ঠ আর একটি শক্ত গানের খাতাকে তালবাদ্য হিসেবে দিনেন চৌধুরীর ঠেকা – এই দুয়ে মিলেই তৈরি হয় এক ইতিহাস, পৌঁছে যায় আকাশবাণীর অন্দরমহলে। ১৫ এপ্রিল আকাশবাণীর বিখ্যাত অনুষ্ঠান ‘সংবাদ পরিক্রমা’য় বাজানো হয় ঘরোয়াভাবে গাওয়া সেই গান; একটানা নয়, বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মাঝে মাঝে। সেইদিন বেশ কয়েকবার এই ভাষণ ও গানের যুগলবন্দি বাজানো হয়েছিল বেতারে সেদিন রাতে। 


এর প্রতিক্রিয়াও জানিয়ে রাখা দরকার। পরেরদিন সেই চায়ের দোকানে যেতেই সবাই জড়িয়ে ধরেছিলেন অংশুমান রায়কে। আর উপেনবাবু? তাঁর ডাক পড়েছিল কেন্দ্র-অধিকর্তার ঘরে। সেখানে উপস্থিত সকলে তাঁকে অভিনন্দিত করে জানান এক ঐতিহাসিক অনুষ্ঠান করে ফেলেছেন তিনি গতরাতে। অভিনন্দিত হয়েছিলেন গানের গীতিকারও। বলাই বাহুল্য, এই গান বারবার উদ্দীপনা যুগিয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের। বাংলাদেশের বহু মানুষ এই গানটিকে তাদের জাতীয় সঙ্গীতের পরেই স্থান দেন।

তুমুল জনপ্রিয়তার দরুন এর হপ্তাখানেক পরই ২২ এপ্রিল হিন্দুস্তান রেকর্ড কোম্পানি থেকে এই গানটি রেকর্ড করেন অংশুমান রায়। সেই ৪৫ আরপিএম ছোট রেকর্ডের এক পিঠে ছিল ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে’ আর অন্য পিঠে ছিল এই গানটিরই ইংরেজি রূপান্তর, লিখেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন নিজেই এবং গেয়েছিলেন অংশুমান রায় ও করবী নাথ। গানটি হল – ‘এ মিলিয়ন মুজিবরস্ সিঙ্গিং’। 

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, শ্যামল মিত্র, অংশুমান রায়, নির্মলেন্দু চৌধুরী, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মতন তাবড় তাবড় শিল্পীরা এই সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষিতে বহু গান রেকর্ড করেছেন। বেশিরভাগ গানই প্রকাশিত হয়েছে ১৯৭১-’৭২ এর মধ্যে। কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক।


১৯৭১ সালে ‘বাংলা! আমার বাংলা!’ নামের একটি ইপিতে সলিল চৌধুরীর কথায় ও সুরে মান্না দে চারখানি গান রেকর্ড করেন। সহশিল্পী হিসেবে ছিলেন সবিতা চৌধুরী ও অন্যান্যরা। ইপি রেকর্ডের এক পিঠে ছিল ‘ধন্য আমি জন্মেছি মা তোমার ধূলিতে’ এবং ‘মানবো না এ বন্ধনে’ আর অপর পিঠে ছিল ‘ও আলোর পথযাত্রী’ এবং ‘আহ্বান শোন আহ্বান’। দুই পিঠেরই প্রথম দুইটি গান কিন্তু লেখা হয়েছিল অনেক আগে আইপিটিএ'র জন্য, পরে মুক্তিযুদ্ধের সময়ও অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। ‘ধন্য আমি জন্মেছি মা’ গানটি একটি অসম্পূর্ণ প্রজেক্টের জন্য রেকর্ড করেন সুচিত্রা মিত্রও। ঐ একই বছর এইচএমভি থেকে মান্না দে সমবেত কণ্ঠে রেকর্ড করেছিলেন দুটি রবীন্দ্রসঙ্গীত -  ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ এবং বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। রবীন্দ্রনাথের এই অমর গানটি প্রধানত শেখ মুজিবর রহমানের নির্দেশেই বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত রূপে নির্ধারিত হয়। সুচিত্রা মিত্রও রেকর্ড করেছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতখানি। তাঁর কণ্ঠেই গানটি অধিক জনপ্রিয়। সুচিত্রা মিত্রর গাওয়া এই গানটি এবং অংশুমান রায়ের গাওয়া পূর্বোল্লিখিত গান ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে’ – এই দুটি রেকর্ড স্বয়ং বঙ্গবন্ধুকে উপহার দিয়েছিলেন অমিতাভ চৌধুরী। সঙ্গে দিয়েছিলেন অখণ্ড গীতবিতান, সঞ্চয়িতা এবং সমগ্র রবীন্দ্র-রচনাবলী। তাঁর লেখা ‘জলছবি’ গ্রন্থে তিনি বলছেন, 'উপহার পেয়ে তিনি (বঙ্গবন্ধু) খুব খুশি। কখনও খোলেন সঞ্চয়িতার পাতা, কখনও দেখেন রবীন্দ্রনাথের ছবি। একবার বলেন, ‘আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথের এই চোখ দুটিতে কী আছে বলুন তো? দেখুন দেখুন, চেয়ে দেখুন, চোখ দুটিতে জ্বলজ্বল করছে মানুষের প্রতি ভালোবাসা। এই জন্যেই তো তাঁকে আমি এত ভালোবাসি’। সত্যিই, বাঙালী হৃদয়ের সবরকমের আবেগের মতন মুক্তিযুদ্ধের যোদ্ধাদের অনুপ্রেরণাতেও তাঁদের সঙ্গে ছিল বিশ্বকবি তথা দুই স্বাধীন রাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান। তাই স্বাভাবিকভাবেই বঙ্গবন্ধুর প্রিয় কবি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ; প্রিয় কবির প্রিয় গানকে তিনি বেছে নিয়েছিলেন তাঁর নিজের দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে। এছাড়াও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ে 'ধনধান্যে পুষ্পে ভরা' গানটিও ছিল তাঁর খুব প্রিয়।


অনেকেরই হয়ত অজানা যে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি গেয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও। সেকথায় যাওয়া যাবে পরে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে মনে রেখে বেশ কিছু গান বাণিজ্যিক রেকর্ডে প্রকাশিত হয় এপার বাংলা থেকে। সেই সময় আবিদুর রহমানের কথায় ও নিজের সুরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় রেকর্ড করেছিলেন দুটি গান। তার মধ্যে একটি ছিল ‘বাংলার দুর্জয় জনতা মুজিবের মন্ত্রের দীক্ষায় ঝঞ্জার বেগে আজ ছুটছে/সাত কোটি ধমনীতে রক্ত টগবগ টগবগ ফুটছে…’ এবং ‘অপরটি ছিল ‘হরিণের মত তার সুমধুর চোখ দুটি মেলে’। দ্বিতীয় গানটি সত্যিই মনে বিস্ময় জাগায়! একটি নিষ্পাপ বালিকার গল্প, যুদ্ধের পাশবিক পরিণতি তার জীবনের সমস্ত গৌরবটুকু কেড়ে নেয় অচিরেই, গানের সঞ্চারীতে তার প্রতিবিম্ব – ‘একদিন এ মেয়ের জীবনে হঠাৎ নেমে এলো এক কালো রাত/বর্বর মিলিটারি পশু এসে হিংস্র থাবায়/লুঠ করে নিয়ে গেলো তার জীবনের সব গৌরব আর সম্পদ হায়!' এভাবেই অগণিত মা-বোনেদের কত শত অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল সেই সময় তার হিসাব ইতিহাস রেখেছে কি? ইতিহাস যদি মনে নাও রাখে, এই গান বারবার যেন চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের মনে করিয়ে দেয় যুদ্ধের ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির কথা, সেই অন্ধকার দিকগুলির কথা; মনে করিয়ে দেয় আমাদেরও যে এই স্বাধীনতা কত না রক্তপাত, কত শত মানুষের মান-ইজ্জত বিক্রি করে কেনা!

এই নিষ্ঠুর, পাশবিক যুদ্ধের সমকালীন পরিবেশের এক ঝলক আমরা দেখতে পাই ঋত্বিককুমার ঘটক পরিচালিত এবং বিশ্বজিৎ প্রযোজিত ও অভিনীত ‘দুর্বার-গতি পদ্মা’(১৯৭১) তথ্যচিত্রে। এই তথ্যচিত্রে বম্বের বহু কলাকুশলীদের সঙ্গে দেখা যায় কলকাতার বহু সঙ্গীতশিল্পীকেও। শচীনদেব বর্মণ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, সলিল চৌধুরী প্রমুখদের গাওয়া গান এই তথ্যচিত্রের বিশেষ আকর্ষণ। শচীনদেব বর্মণের কণ্ঠে ‘আমি টাগডুম টাগডুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল’, মান্না দে’র কণ্ঠে ‘শুনো শুনো ভাই সব হিন্দু-মুসলমান’, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘অবাক পৃথিবী’ ইত্যাদি গানগুলি এই তথ্যচিত্রের সম্পদ। এইখানেই আমরা হেমন্ত-কণ্ঠে শুনতে পাই ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের কিয়দংশ, যা আমাদের কাছে এক পরম প্রাপ্তি। বাংলা তথা সারা ভারতবর্ষের শিল্পীরা কীভাবে অর্থ সংগ্রহ করে বাংলাদেশকে সাহায্য করেছিলেন তার প্রমাণও পাওয়া যায় এই তথ্যচিত্রে, এ এক অমূল্য দলিল!


১৯৭২ সালে সলিল চৌধুরীর কথায় ও কানু ঘোষের সুরে মান্না দে রেকর্ড করেন দুটি গান। একটি হল ‘সাড়ে সাত কোটি বাঙালির হে বিধাতা তোমায় নমস্কার’ ও ‘ও ভাই ভাইরে চল ঘরে ফিরে যাই’। আরো দুটি গান তৈরি হয়েছিল সেই সময়। গান দুটি হল ‘এই দেশ এই দেশ আমার এই দেশ’ আর ‘ফিরে আয় ফিরে আয়’, মান্না দে এবং সবিতা চৌধুরীর দ্বৈত কণ্ঠে গাওয়া। এই দুটি গান আকাশবাণী থেকে রম্যগীতি হিসেবে প্রচারিত হয়। ঠিক হয়েছিল গানদুটি একটি স্ট্যান্ডার্ড রেকর্ডে প্রকাশিত হবে, কিন্তু কোনো কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি। পরে এগুলি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত একটি ছায়াছবি ‘রক্তাক্ত বাংলা’(১৯৭২)-তে ব্যবহৃত হয়। 

এই সময় ফান্ড রেইসিং-এর জন্যে পশ্চিমবঙ্গের বহু শিল্পী ভারতের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠান করতেন। ভারতের পশ্চিমাংশের বহু প্রদেশে বহু অনুষ্ঠানে একটি হিন্দি গান ‘জানেওইয়ালে সিপাহীসে পুঁছো’ মান্না দে খুব গাইতেন। সলিল চৌধুরীর সুরে এই গানটি শিল্পী ‘উসনে কাঁহা থা’ নামের একটি হিন্দি ছবিতে গেয়েছিলেন ১৯৬১ সালে। সমকালীন সময়ে ভারত-চিন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে এই গান অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ছিল, পরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও জনপ্রিয় হয়। এরকম আরো একটি উদাহরণ দেওয়া যায়। ১৯৬১ সালে আকাশবাণীতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নিজের সুরে ও গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় দুটি গান রেকর্ড করেন – ‘মাগো ভাবনা কেন’ এবং ‘এ দেশের মাটির ‘পরে’। পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই গান নতুন করে প্রাণ সঞ্চার করে জাতির জীবনে। এমন সার্থক দেশাত্মবোধক ঐতিহাসিক গান আর কটাই বা আছে? 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের ঠিক পরবর্তী সময়েরই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য একটি সংকলন হল একটি এলপি রেকর্ড যার নাম ছিল ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’, প্রকাশিত হয়েছিল গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে। এই রেকর্ডের দুই পিঠ মিলিয়ে ছিল মোট ১২টি গান। এক পিঠে ছিল ছয়টি গান – গোবিন্দ হালদারের কথায় সমবেত কণ্ঠে গাওয়া ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য ওঠে’, সলিল চৌধুরীর কথায় সমবেত কণ্ঠে ‘এই সূর্যোদয়ের ভোরে এসো’, মুস্তাফিজুর রহমানের কথায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘ভেবোনা গো মা তোমার ছেলেরা হারিয়ে গিয়েছে পথে’, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় শ্যামল মিত্র ও আরতি মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘তোমাদের উড়িয়ে দিলাম’, আবিদুর রহমানের কথায় মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘ওরা দুটি পাখির মতো’ এবং গৌরীপ্রসন্ন’র কথায় সমবেত কণ্ঠে ‘মাটির প্রদীপ থেকে’। আর অপর পিঠে ছিল আরো ছয়টি গান - গৌরীপ্রসন্ন’র কথায় হেমন্ত-কণ্ঠে ‘মাগো ভাবনা কেন’, আব্দুল গফফর চৌধুরীর কথায় নির্মলেন্দু চৌধুরী ও বনশ্রী সেনগুপ্তর গাওয়া ‘শহীদ মিনার ভেঙেছ তোমরা’, মহম্মদ মোসাদ আলির কথায় সমবেত কণ্ঠে ‘বলো বাঙালির জয়’, গৌরীপ্রসন্ন’র কথায় হেমন্ত-কণ্ঠে ‘এ দেশের মাটির ‘পরে’, নির্মলেন্দু চৌধুরী ও বনশ্রী সেনগুপ্তর গাওয়া ‘বঙ্গবন্ধু ডাকে রে’ এবং শ্যামল মিত্রর গাওয়া ‘আমরা সবাই বাঙালী’। গানগুলির সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন সমর দাস। প্রতিটি গানই এক কথায় অনবদ্য।

শুধুমাত্র রাজনৈতিক ও সামরিক সাহায্য, প্রশাসনিক দায় এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রতি অপর রাষ্ট্রের সহমর্মিতা নিয়েই যে ভারতবর্ষ বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল এমন নয়, সাংস্কৃতিকভাবেও কিন্তু যতখানি সাহায্য করা যায় ভারত তা করেছিল। ভারতীয় তথা বঙ্গদেশের অন্যতম প্রধান ঐতিহ্য যে সঙ্গীত, সেই সঙ্গীতই কিন্তু বাংলাদেশের বহু যোদ্ধাকে জুগিয়েছে উদ্দীপনা, জাগিয়ে তুলেছে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের দুর্নিবার আকাঙ্খাকেও। এই স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান শরীক শেখ মুজিবর রহমানকে নিয়েও এপার বাংলায় রচিত হয়েছে বহু গান যার উদাহরণ আমরা পূর্বেই দেখেছি। এপার বাংলার মানুষ কোনোদিন কাঁটাতারের ব্যবধানে ওপার বাংলাকে দূরে ঠেলে দেয়নি, বরং আপন করেই নিয়েছে বরাবর। এবং বলাই বাহুল্য, পূর্বোল্লিখিত গানগুলি দুই বাংলার অদৃশ্য দুই নাড়ির মধ্যে যে যোগসূত্র রচনা করেছে, তা চিরন্তন।

তথ্য সহায়তা ও চিত্র সৌজন্যেঃ সপ্তর্ষি ঘটক, ভাস্কর রায় ও সপ্তর্ষি ভট্টাচার্য

তথ্যসূত্রঃ 'জলছবি' - অমিতাভ চৌধুরী ('মিত্র ও ঘোষ')

Powered by Froala Editor

More From Author See More